লিখেছেন; ভবভূতি ভট্টাচার্য
বই: বাংলা সাহিত্যে মুসলমান
লেখক: আবদুল মান্নান সৈয়দ।
প্রকাশক: ইসলামিক ফাউন্ডেশন, শেরেবাংলা নগর, ঢাকা।
প্রথম প্রকাশঃ জুন ১৯৯৮, তৃতীয় সংস্করণ মে ২০০৯
“আজি, পুণ্য প্রেমের পুণ্য পরশে হাসিছে জগৎ অমিয়-হাসি।
আজি, কুঞ্জকাননে সৌরভ বিলায়ে ফুটেছে অযুত কুসুমরাশি।
আজি, কাননে গাইছে পাপিয়া গাইছে কোকিল মধুর স্বরে।
আজি আসিবে সে-জন এ’ সৌরজগৎ বাঁধা আছে যার প্রেমের ডোরে।” [‘অশ্রুমালা’, কবিঃ মুন্সী কায়কোবাদ (১৮৫৭-১৯৫১)]
“বঙ্গবাসী মুসলমানদের দেশ-ভাষা ও মাতৃভাষা বাঙ্গালা। মাতৃভাষায় যাহার আস্থা নাই, সে মানুষ নহে।” লিখেছিলেন মীর মশাররফ হোসেন (১৮৪৭-১৯১১)।
“আমার দেশের মৃত্যু নাই। আমার দেশের আত্মা যে জনগণ, তাহারও মৃত্যু নাই। তেমনই অমর আমার এই বাঙলা ভাষা।” —আবদুল করিম সাহিত্যবিশারদ (১৮৭১-১৯৫৩)।
এই তিনজন ছিলেন প্রাক্নজরুলযুগের প্রতিনিধিস্থানীয় সৃষ্টিশীল আধুনিক বাঙালী-মুসলমান সাহিত্যিক। এবং ছিলেন মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক শান্তিপুরী (১৮৬০-১৯৩৩)। কলকাতা কেন্দ্রিক পশ্চিমবাঙলার সাহিত্যজগত এঁদের প্রায় চেনেইনা। এ’পারের বহুল প্রচারিত ‘সংসদ বাঙালী চরিতাভিধানে’ মহাকবি কায়কোবাদের নামও নেই, যাঁর ‘মহাশ্মশান’ ও ‘অশ্রুমালা’ কাব্য ছাড়া বাঙলা সাহিত্যের আলোচনা কখনও সম্পূর্ণ হতে পারে না (যদিও ঢাকা বাংলা একাডেমীর ‘চরিতাভিধান’টিতে উনি সসম্মান আলোচিত)-নজরুল কায়কোবাদ সাহেবের পদস্পর্শ করে কদমবুসি করতেন ও ‘আমাদের সকলের গুরু’ বলে মানতেন। প্রমথ বিশী-বিজিত দত্ত সম্পাদিত ‘বাঙলা গদ্যের পদাঙ্ক’, বা অসিতকুমার বন্দ্যোপাধায়ের ‘বাঙলা সাহিত্যের সম্পূর্ণ ইতিবৃত্তে’ এ’হেন মূলতঃ পূর্ববঙ্গীয় মুসলিম সাহিত্যিকগণ একেবারেই স্থান পাননি। এতে এনাদের মান ঘাটেনি, সংকলনগুলিই পঙ্গু হয়েছে। আসলে, এ’সব হল ঊনবিংশ শতাব্দীর তথাকথিত ‘নবজাগরণ’-এর কুফল, যেটা আবদ্ধ ছিল মুষ্টিমেয় কলকাতাকেন্দ্রিক উচ্চবর্ণীয় হিন্দুপুরুষের মধ্যেই। নারীদের এরা যেমন কোটরাগত করে রেখেছিল, তেমনই নিম্নবর্ণীয় হিন্দু ও মুসলমানগণ ছিলেন সম্পূর্ণ ব্রাত্য। কলকাতার চৌহুদ্দি ডিঙোলেই তো পাড়াগাঁ— দখ্নে-নেড়ে-বাঙাল-উড়ে-খোট্টা বলে সকলকে অবজ্ঞা করা! অসহ্য!
এতে অবশ্য বাঙলাসাহিত্যের এই ধারাটি রুদ্ধ হয়নি, বরং দিনে দিনে ভাষাকে পুষ্ট করে চলেছে। ‘এই ধারা’ কেন বলতে হল? এটা কি অন্য কোনো ধাঁচের বাঙলা লেখা, আটলান্টিকের এ’পার-ও’পারে যেমন ইংরিজির দুই ধারা প্রবাহিত হয়ে চলেছিল অষ্টাদশ শতক থেকে? একদমই তা নয়। ছিল একই অখণ্ড বাঙলাদেশ, ভাষা-বানান-অভিজ্ঞতা সবই এক। তবুও সামান্য ব্যতিক্রম সত্ত্বেও ‘ভারতবর্ষ’,‘প্রবাসী’, ‘সবুজপত্র’ মূলতঃ হিন্দুদের, ও ‘সাওগাত’ ‘মোহম্মদি’ ‘মোসলেম ভারত’ মূলতঃ মুসলমানদের পত্রিকাই থেকে গিয়েছিল। দেশবিভাগের মূলটি কত গভীরে ছিল তা বুঝতে অসুবিধে হয় না।
***
এই পরিপ্রেক্ষিতেই নামী প্রাবন্ধিক আবদুল মান্নান সৈয়দ সাহেবকে “বাংলা সাহিত্যে মুসলমান” লিখতে কলম ধরতে হবে এতে আর আশ্চর্য কী? যদিও ভাষা ও সাহিত্যের এই ধর্মভিত্তিক বিভাজন বেদনাদায়ক। তবু, নৈর্ব্যক্তিক আলোচনার জন্য এর দরকার আছে। নৈলে দুই মলাটের মধ্যে এ’সব কোথায় পেতুম বা জানতে পারতুম……?
১. চতুর্দশ শতকের প্রথম বাঙালী-মুসলমান কবি শাহ্ মুহম্মদ সগীরের ‘ইউসুফ-জুলেখা’ কাব্যের নমুনা।
২. প্রথম বাঙালী-মুসলমান গদ্যকার খোন্দকার শামসুদ্দীন মোহম্মদ সিদ্দিকি (১৮০৮-১৮৭০)-র গদ্যগ্রন্থ ‘উচিত শ্রবণ’ (১৮৬০)। [একটু গদ্যনমুনা থাকলে বেশ হত।]
৩. আবদুল করিম সাহিত্য বিশারদের প্রাচীন ও মধ্যযুগীয় বিপুল পুঁথিসংগ্রহের প্রতি ক্ষিতিমোহন সেনের সশ্রদ্ধ উক্তি, “উনি কোনো ব্যক্তি নহেন, একটি প্রতিষ্ঠান!” দীনেশচন্দ্র সেন তাঁর গবেষণায় আবদুল করিম সাহেবের কাছে ঋণী ছিলেন।
৪. সেই কবে ১৯১৯-এ মোজাম্মেল হক (শান্তিপুর) সাহেবের গদ্য পড়ে মুগ্ধ স্যর আশুতোষ তাঁকে কলিকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ম্যাট্রিকুলেশনের বাঙলা-পরীক্ষক নিযুক্ত করেন। হক সাহেব পরে ‘মোসলেম ভারত’ পত্রিকা সম্পাদনা করে ও ‘জোহ্রা’ (১৯৩৫) উপন্যাস লিখে বিখ্যাত হন।
৫. বাঙলায় মুসলিম নবজাগরণের পুরোধা পুরুষ ছিলেন খানবাহাদুর আহ্ছানউল্লাহ্(১৮৭৩-১৯৬৫)—প্রথম মুসলিম আই.ই.এস. (ইন্ডিয়ান এডুকেশন সার্ভিস)। তাঁর ‘ইছলামের বাণী ও পরমহংসের উক্তি’ (১৯৫৬) গ্রন্থের আলোচনা অতি মনোজ্ঞ ও শিরোধার্য।
বাঙালী মুসলিম সাহিত্যিকগণের মধ্যে কাজী নজরুল ইসলামের স্থান সর্বোচ্চে। তাই তাঁর ওপর তিনটি অধ্যায় রাখা যথোপযুক্ত হয়েছে; তার মধ্যে শেষের দুটি ‘আল্লাহ্কে নিবেদিত গীতিগুচ্ছ’ ও ‘ রসুল (সা.) নিবেদিত গীতিগুচ্ছ’ —পশ্চিমে যার পরিচিতি কম।
এ’হেন মণিমুক্তো ছড়ানো এ’গ্রন্থের পৃষ্ঠায় পৃষ্ঠায়। আধুনিক বাঙলা সাহিত্যের সম্যক পরিচয় পেতে এ’হেন গ্রন্থের তাই কোনো বিকল্প নেই। তুলনা নেই আঁটোসাটো ভূমিকা খানির। মান্নান সাহেব আমাদের ধন্যবাদার্হ হলেন। বইখানি সুধীপাঠকের ব্যক্তিগত গ্রন্থাগারে স্থায়ী ঠাঁই পাক। কয়েকটি প্রাসঙ্গিক কথা এই ধরা থাক্ঃ
১. কায়কোবাদ থেকে শুরু করে কবি আবদুস সাত্তারে (জ.১৯২৭) শেষ এই গ্রন্থের আলোচনা—মাত্র ১৪ জন মুসলিম সাহিত্যিককে নিয়ে, ২৬৬ পৃষ্ঠাব্যাপী। আবু ইসহাক (‘সূর্যদীঘল বাড়ি’), সৈয়দ ওয়ালীউল্লাহ্(‘লালসালু’) বা মুনীর চৌধুরী (‘মানুষের জন্য’)-র মত প্রতিনিধিস্থানীয় লেখকগণ কোন্যুক্তিতে বাদ গেলেন বা সামান্যমাত্র আলোচিত হলেন তার কোনো মানদণ্ড বা উল্লেখ কোথাও নেই।
২. পশ্চিমবঙ্গের মুসলিম লেখকগণ প্রায়-সম্পূর্ণই উপেক্ষিত থেকে গেছেন, সে সেকালের এস্. ওয়াজেদ আলী সাহেব হোন্ বা অতুলনীয় সৈয়দ মুজতবা আলী (সিলেটি হলেও ওনার প্রতিষ্ঠা তো পশ্চিমেই), আবু সয়ীদ আইয়ুব, বা একালের সৈয়দ মুস্তাফা সিরাজ বা আফসার আহমেদ। এর কারণ কী?
৩. রাসসুন্দরী দেবীর পরেপরে লেখনী ধরেছিলেন কুমিল্লার ফয়জুন্নেসা চৌধুরাণী (১৮৩৪-১৯০৩), তারও পরে নূরুন্নেছা খাতুন বিদ্যা বিনোদিনী (১৮৯৪-১৯৭৫), সৈয়দা খাতুন আখতারমহল (১৯০০-১৯২৮), নজরুল শিষ্যা সৈয়দা মোতাহেরা বানু (১৯১১-১৯৭৩) প্রমুখ। বাঙলাসাহিত্যে মুসলিম-লেখিকাগণ সাধারণতঃ উপেক্ষিতাই থেকে যান।মান্নান সাহেবের এই বইয়েও তাঁরা তা-ই থাকবেন? বিশেষতঃ, বেগম রোকেয়া ও সুফিয়া কামালের প্রায়-অনুল্লেখ মানা গেল না। মুসলিম লেখিকাদের ওপর এক সম্পূর্ণ অধ্যায় থাকলে আশা পূরতো।