আমার মাস্টার্স ভাইভাতে একটা প্রশ্ন ছিল-
তোমার কাছে কি মনে হয়, পূর্ব এবং পশ্চিম পাকিস্তানে অর্থনৈতিক বৈষম্য ছিল?
উত্তরটা একবাক্যে দেওয়ার মতো ছিল না। বিভিন্ন রেফারেন্স দেওয়ার পর শেষটাই বললাম, ছিল না। আমার দীর্ঘ সময় ধরে দেওয়া রেফারেন্সগুলোকে কোন মূ্ল্যই দিলেন না পরীক্ষকরা। এমন দৃষ্টিতে আমার দিকে তাকালেন, যেন আমি ভিনগ্রহের কোন প্রাণী।
শেখ মুজিবুর রহমান একবার করাচী গিয়েছিলেন ড. সাজ্জাদ হুসাইনের সঙ্গে। সেখানে গিয়ে করাচীর চাকচিক্য দেখে ড. সাজ্জাদকে শেখ মুজিব বলেছিলেন, স্যার, আমি করাচীর এই সুদর্শন বিল্ডিংগুলোতে পূর্ব পাকিস্তানের পাটের গন্ধ পাচ্ছি।
করাচী অতি প্রাচীন একটা শহর। এই শহরের জৌলুস বাড়িয়েছে অনেকগুলো সভ্যতা। একসময় মুঘলদের গুরুত্বপূর্ণ শহর ছিল করাচী। ব্রিটিশদের কাছেও এর গুরুত্ব ছিল অনেক। হাজার বছর ধরে এই শহর উন্নতি করেছে। এখানে শিশু রাষ্ট্র পাকিস্তানের উন্নতি করার বিষয় ছিল খুব কমই। শেখ মুজিব কেমন করে এমন কথা বলতে পারলেন! বিস্মিত হয়েছিলেন ড. সাজ্জাদ হুসাইনও।
এটা একটা উদাহরণ মাত্র। রেহমান সুবহানরা যে অর্থনৈতিক বৈষম্যের কথা বলেছিলেন তা অনেকটা দাদা ভাইদের কাছ থেকে ধার করা। দাদা ভাই নওরোজিরা ” ড্রেইন অব ওয়েলথ” থিওরি দিয়ে বেশ ভাল সাড়া ফেলেছিলেন উনিশ শতকে। মূলত ভারতীয় স্বাধীনতা আন্দোলনে গণজোয়ার সৃষ্টি হয়েছিল এই থিওরির উপর ভিত্তি করেই। দাদা ভাইরা বুঝেছিলেন, জনগণকে কেবল তখনই সার্বিক আন্দোলনে নিয়ে আসা যাবে যখন তাদেরকে অর্থনৈতিক লাভ-ক্ষতির বিষয়টা বুঝানো যাবে। রেহমান সুবহানরা ঠিক এই কাজটাই করেছিলেন পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের সঙ্গে।
একটা নতুন দেশে অনেক সমস্যাই ছিল। এর মধ্যে অর্থনৈতিক সমস্যাও ছিল নিশ্চয়ই। কিন্তু এই বিষয়টাকে সমাধানের দিকে না নিয়ে বরং ক্ষমতা অর্জনের হাতিয়ারে পরিণত করেছিল স্বার্থান্বেষী একটা শ্রেণী।
অর্থনৈতিক এই বৈষম্যের বিষয়টা কতটুকু সত্যি! জি ডব্লিউ চৌধুরী (দি লাস্ট ডেইজ অব ইউনাইটেড পাকিস্তান), রওনক জাহান (পাকিস্তান: ফেইলার ইন ন্যাশনাল ইন্টিগ্রেশন), মতিন উদ্দিনদের (ট্র্যাজেডি অব এররস) গ্রন্থগুলো অধ্যয়ন করলে অনেক বিষয়েই নিশ্চিত হওয়া যায়। তারপরও রিচার্ড এন্ড সিসনের (ওয়ার এন্ড সিসেশন) গ্রন্থ অধ্যয়ন করা যায়। সবগুলোতে অর্থনৈতিক বৈষম্যের বিষয়টা স্পষ্ট করা আছে। পূর্ব পাকিস্তানে কখনো কখনো অর্থনেতিক বছরে যে বাজেট দেওয়া হতো তা খরচই হতো না। খরচ করা হতো না কেন? এটা একটা প্রশ্ন বটে। এই প্রশ্নের উত্তর পূর্ব পাকিস্তানেরই দেওয়া উচিত। ” ড্রেইন অব ওয়েলথ” থিওরি যে এক্ষেত্রে একটা বাতুলতা ছিল তা স্বীকার করতেই হবে।
১৯৭১ সালের যুদ্ধে আরও বড় একটা প্রশ্ন ছিল, ক্ষমতা। পূর্ব পাকিস্তানকে ক্ষমতা কম দেওয়া হতো। আদৌ কি এটা সত্যি? ১৯৪৭ সালে ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা পাওয়া সময় পূর্ব পাকিস্তানে একজনও আইসিএস অফিসার ছিল না। তাহলে ক্ষমতা কাকে দিবে? এরপরও অনেক বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষককে প্রমোশন দিয়ে আমলা হিসেবে নিয়োগ দেওয়া হয়েছিল। প্রথম শ্রেণীতে উন্নীত হয়েছিল অনেক দ্বিতীয় শ্রেণীর অফিসার। এসব করতে গিয়ে মূলত পুরো সিস্টেমেই একটা হ জ ব র ল অবস্থার সৃষ্টি হয়েছিল।
মূল সমস্যাটা ছিল, অযোগ্যরা যখন ক্ষমতা কিছুটা স্বাদ পেল, ভাবল, আরও বেশি ক্ষমতা তাদের প্রয়োজন। এই ক্ষমতার লোভই তাদেরকে একটা মহা ভুলের দিকে নিয়ে গেল। পশ্চিম পাকিস্তানি নেতাদের কোন দোষ ছিল না, এমনটা বলা যাবে না। তবে যেসব বিষয়কে কেন্দ্র করে একটা বৃহৎ জনগোষ্ঠীকে স্বাধীনতার দাবির দিকে নিয়ে গিয়েছিল পূর্ব পাকিস্তানের নেতারা তা ভুলের উপরই নির্মিত হয়েছিল।
কিছুদিন আগেই স্কটিশরা স্বাধীনতার উপর গণভোট করেছে। ফলাফল, ব্রিটেনের সঙ্গে থাকার পক্ষেই জনগণ ভোট দিয়েছে। কারণ, সেখানকার মানুষ আবেগের চেয়ে বাস্তবতাকে বেশি গুরুত্ব দিয়েছে। এখন যারা স্বাধীনতার পক্ষে ভোট দিয়েছে তাদেরকে কি দেশ থেকে বের করে দিতে হবে?
দিন কয়েক আগে আমার এক সাংবাদিক বন্ধু বলছিলেন, যুদ্ধাপরাধী তারাই যারা স্বাধীনতার সময় মুক্তিযুদ্ধের বিরোধিতা করেছে। যে কোন ঘটনার সময় পক্ষ বিপক্ষ থাকবেই। এর মানে এই নয় যে বিরোধিতাকারীররা সবাই ভুল করেছে। আমি যখন সেই সাংবাদিক বন্ধুকে বললাম, ফররুখ আহমেদও তো স্বাধীনতার বিরোধিতা করেছে। সে বলল, ফররুখ আহমদ তো জামায়াতি ছিল। মনে মনে ভাবলাম, এমন মহান ব্যক্তিদের নিয়েও এসব সরলমনা (!) সাংবাদিকদের মনে কি ভয়ঙ্কর ঘৃণা লুকিয়ে আছে।
এখন স্বাধীনতা নিয়ে যেসব প্রশ্ন আছে সেগুলে একে একে সামনে আনতে হবে। অনেকেই বলে, এতে দ্বিধাবিভক্তি আরও বাড়বে। বাড়তে তো হবেই। কোন মিথ্যার উপর ভিত্তি করে একটা জাতির অস্তিত্ব দাঁড়িয়ে থাকতে পারে না। আর সত্য তো একটাই। হয়ত তারা সঠিক অথবা ওরা সঠিক। একটা পক্ষকে বিজয় লাভ করতেই হবে। এখনই উপযুক্ত সময় বিতর্কটা আরও বড় আকারে সামনে আনার।