‘মানুষ’। এই পৃথিবীর সকল সৃষ্টির কেন্দ্রবিন্দু। এই পৃথিবীর সকল সৌন্দর্য্যের উৎস, সকল কর্ম ব্যস্ততার কারণ। পৃথিবীর যত কাজ যত জ্ঞান গবেষণা সবের লক্ষ্য একটিই। আর সেটি হচ্ছে মানুষের সেবা করা। মানব জীবনে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান করে মানব জীবনকে গতিশীল করা। কিন্তু এত জ্ঞান-গবেষণার পরও কেন মিলছেনা কাংখিত সেবা। কেন মানুষে মানুষে এত বিভেদ। কেন বেড়েই চলেছে মানুষে মানুষে এত বৈষম্য। কেন পাওয়া যাচ্ছেনা মানব জীবনে বিদ্যমান সমস্যার সমাধান।
এর বহুবিধ কারণ থাকলেও, অন্যতম এবং প্রধানতম কারণ হচ্ছে- যে ‘মানুষ’ই হচ্ছে সকল জ্ঞান-বিজ্ঞানের সাধনার বিষয়, সেবার লক্ষ্যবস্তু সে ‘মানব/মানুষ’ সম্পর্কে সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গির অনুপস্থিতি।
তাহলে মানুষের পরিচয় সম্পর্কিত সঠিক ও পূর্ণাঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গি কি?
এক কথায় মানুষের পরিচয় দেয়া কষ্টসাধ্য কাজ। আর এই কষ্টসাধ্য কাজটি সম্পাদন করেছেন সাবেক বসনিয়াক প্রেসিডেন্ট আলিয়া আলী ইজেতবেগোভিচ তার প্রায় ৩৪০ পৃষ্ঠার বই Islam Between East and West এ। অসাধারণ দক্ষতায় তিনি মানুষের সঠিক, পুর্ণাংগ ও সার্বজনীন পরিচয় তুলে ধরেছেন। মানব সম্পর্কিত অন্যান্য প্রচলিত সকল ধারণা ও মতবাদের ব্যর্থতা ও অসংলগ্নতাকে তুলে ধরেছেন অসাধারণ দক্ষতায়। সেই বই এর বিভিন্ন অংশ হতেই মানব সম্পর্কিত বাক্যমালা- সংকলন করা হলো।
প্রথমতঃ মানুষ একটি সৃষ্ট জীব।
দ্বিতীয়তঃ মানুষ একটি আধ্যাত্মিক জীব।
তৃতীয়তঃ মানুষ বিবর্তিত নয় বরং আকস্মিক প্রক্রিয়ার মাধ্যমে সৃষ্ট।
চতুর্থতঃ মানুষ এই পৃথিবীতে একটি আগন্তুক। তার উৎপত্তি এখানে নয় এবং এখানে তাঁর অবস্থান আগন্তুকের মতই সাময়িক।
পঞ্চমতঃ মানবীয় চরিত্রে কিছু পাশবিক বিষয় পরিলক্ষিত হলেও সে পশু নয় কিংবা পশুর উত্তরসূরী নয় যেমন মসজিদ/মন্দির/ চার্চ এবং সামরিক স্থাপনার মধ্যের উপাদানগত মিল থাকলেও সেগুলো এক নয়।
ষষ্ঠতঃ মানুষ একটি মানবিক জীব (সামাজিক বা রাজনৈতিক পরিচয় –একটি খন্ডিত দৃষ্টিভংঙ্গি)। মানবিকতাই মানুষের প্রকৃত পরিচয়। তবে এই মানবিকতার মূল অর্থ – তাকে মানুষ এবং তার স্বাধীনতার স্বীকৃতি।
মানুষকে মানুষের মূল অবস্থান হতে সরিয়ে এনে পশুত্বের স্তরে নিয়ে আসা এবং তাকে কেবলমাত্র পশুর মতো উৎপাদক ও ভোক্তা বিবেচনা করাও সবচেয়ে বিমানবিকীকরণ প্রচেষ্টা। আর এটিই হচ্ছে এই পৃথিবীর সকল অবিচার, অনাচার, শোষণ, নিপীড়ন, বৈষম্য, যুদ্ধ-বিগ্রহের মূল কারণ।
কাজেই রাজনৈতিক, সামাজিক, নৃতাত্ত্বিক পরিমন্ডলে জাতীয় কিংবা আন্তর্জাতিক স্তরে যতই তত্ত্ব-মতবাদের কচকচানি করা হোক না কেন, মানুষের এই মূল পরিচয়ের স্বীকৃতি না দেয়া পর্যন্ত কোন সমস্যার সঠিক ও লাগসই ও সর্বজনীন সমাধান আসবেনা। যা হবে তা হচ্ছে-একটি সমস্যার আপাত একটি সমাধান যা সাময়িকভাবে কিছু সমাধান পেশ করলেও চূড়ান্ত বিচারে নিজেই একটি চরম সমস্যা হিসাবে হাজির হয়।
মুসলিম সমাজে এবং মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশে চূড়ান্ত বিশ্বাসে “মানুষ সৃষ্ট জীব এবং এই পৃথিবীতে সে আগন্তুক” এই স্বীকৃতি থাকলেও সামাজিক- রাষ্ট্রিক কিংবা ব্যক্তিক কোন স্তরেই এই তত্ত্ব-প্রসূত আইন-কানুন, বিধি-বিধানের বাস্তবায়ন নেই। বরং মানুষ পশুর বিবর্তিত রুপ এবং ‘পশুর উত্তরপুরুষ ছোট ভাই’ তত্ত্ব প্রসূত যত চিন্তা-চেতনা, আইন-কানুন, বিধি-বিধান রচিত হয়েছে তার অন্ধ অনুসরণ করে চলেছে। ফলে মুসলিম সংখ্যাগরিষ্ঠ দেশগুলোতে যার পরনাই রাষ্ট্রীয় বিশৃঙ্খলা বিরাজমান।
এ সকল বিশৃঙ্খলা মুক্ত হয়ে সুষ্ঠু-সুন্দর ও সুখী ব্যক্তি, সমাজ ও রাষ্ট্র গড়তে হলে মানব পরিচয় এবং এ পরিচয়ের আলোকে সকল তত্ত্ব-আইন কানুন, বিধি-বিধানের বাস্তবায়ন দরকার। এক্ষেত্রে মানুষের ‘প্রকৃত পরিচয়’ এর স্বীকৃতি এবং জীবনের সকল স্তরে এর বাস্তবায়নই একমাত্র মহৌষধ বা প্যানাসিয়া (Panacea)।
…………………………………………………