বেগম জিয়া’র বক্তব্যের মুল বিষয়ে না গিয়ে ভারতদাস সিন্ডিকেট সাংবাদিক গোষ্ঠী তার একটি সাইড মন্তব্যকে নিয়ে তোড়জোড় শুরু করেছে।এর কারন আমাদের বুঝতে সমস্যা হয়না। যাই হউক, বেগম জিয়াকে ধন্যবাদ একটি অতি বিতর্কিত বিষয়ে প্রশ্ন তোলার জন্য (দেখুন : মুক্তিযুদ্ধে নিহতের সংখ্যা নিয়ে খালেদার সংশয়)।এই দেশের মানুষ নেতা-নেত্রীরা প্রেসক্রাইভ না করলে নতুন কিছু ভাবেনা, পড়তে না বললে বা উস্কানী না দিলে কোন কিছুর গভীরে যেতে চায়না।তার মন্তব্যে হয়ত কেউ স্বাধীকার আন্দোলনের সংগ্রামে শহীদ হওয়া মানুষের সংখ্যা নিয়ে যে রাজনীতিটা হয় সেটা নিয়ে একটু ঘাটাঘাটি করবে।
শহীদের সংখ্যা নিয়ে বিতর্কটা রাজনৈতিক।সংখ্যা বাড়া-কমার মাঝে তাদের আত্নত্যগের মহিমা প্রকাশিত হয়না। ১জন মানুষও যদি শহীদ হয় আর তার কারন যদি যৌক্তিক হয় তাহলে বর্তমান প্রজন্মের উচিত হবে তার ত্যাগের স্মরন করা এবং দোয়া করা। আমার এই লেখা মুলত শহীদ সংখ্যা নিয়ে অপ-রাজনীতির মুখোশ উন্মচনের লক্ষ্যে।
১৯৭১ সালে স্বাধীকার আন্দোলনের সংগ্রামে শহীদের সংখ্যা নিয়ে অপ-রাজনীতির বিরুদ্ধে সম্ভবত প্রথম একাডেমিক চ্যালেন্জ করেন ঢাকা ইউনিভার্সিটির শিক্ষক বিশিষ্ট সোসিওলজিষ্ট এবং ইতিহাসবিদ ডক্টর আবদুল মু’মিন চৌধুরী। তিনি লিখেন; “Behind the Myth of 3 Million” (E-book)। তার ঐ লেখার জবাব আজও কেউ দিয়েছে বলে আমার চোখে পরেনি।সর্বশেষ শর্মিলা বোসও এই সংখ্যা রাজনীতির নিয়ে প্রশ্ন তুলেছেন (দেখুন ও সংগ্রহ করুন Dead Reckoning : Memories of the 1971 Bangladesh War) আর সেটাও একাডেমিক জায়গা থেকে। চেতনাবাজরা চেতনার কথা বলে শুধু অপ-রাজনীতি’র লক্ষ্যেই এই সংখ্যা নিয়ে হা হুতাশ করে, কোন দালিলিক প্রমানের দাড় ধারেনা।
সেই জন্য তাদের উপস্থাপন করা দলিল থেকেই তাদের অপরাজনীতির ভ্রান্তিটা ধরিয়ে দেয়ার চেষ্টা করা যাক।
আওয়ামী সমর্থিত ইতিহাসের ন্যারেশানের কর্মি ১৯৭১ সালের স্বাধীকার সংগ্রাম নিয়ে ব্যাপক প্রোপাগান্ডাকারী আওয়ামী পান্ডব অমি পিয়াল কিছু দিন আগে তার ফেইসবুকে একটি ডকুমেন্ট শেয়ার করেছেন। ১৬ ই ডিসেম্বর ১৯৭১ সালে বাংলাদেশ সরকার কর্তৃক প্রকাশিত “Liberation Supplement” যেখানে বিদেশী গন মাধ্যমের বরাতে উল্লেখ করা হয় যে ১.৫ মিলিয়ন মানুষ সেই সময় হত্যার স্বীকার হয়েছেন।
প্রশ্ন উঠতে পারে দেশ যেদিন স্বাধীন হল সেই দিনই কিভাবে জানা গেল এই পরিমান মানুষ খুন হয়েছেন? কে কাউন্ট করল? ভাল কথা, এই ১.৫ মিলিয়নই ৩ মিলিয়ন কিভাবে হয়ে গেল? তাহলে প্রশ্ন উঠে বাকী ১.৫ মিলিয়ন মানুষ কি রাজাকার এবং বিহারী ছিল? রাজাকার ও বিহারীদেরকে সেদিন কিভাবে কঁচু-কাটা করা হয়েছে সেই ইতিহাসে বাংলাদেশের বইগুলোতে এক প্রকার বিরল। এই বিষয়ে প্রশ্ন তোলাও মনে হয় এক ধরনের Original Sin! (আদি পাপ)। কেন? কারন সংগ্রামের আগে ও পরে রাজাকার ও বিহারীদেরকে বিনা বিচারে গনহত্যার দায় পুরোটাই বাংগালী জাতীয়তাবাদীদের উপর বর্তায়, তথাকথিত ১৬তম ডিভিশন তার অন্যতম দায়ী।
রাজাকার ও বিহারীদের হত্যাকান্ড নিয়ে প্রশ্ন তুলে নতুন প্রজন্মের কাছে আমার চেতনা প্রশ্নবিদ্ধ না করে বরং পুরাতন প্রজন্মের কারো কাছ থেকেই ধার করা যাক। জাফর ইকবাল, জি অধ্যাপক জাফর ইকবাল স্যারের কথাই বলছি।খেতাবহীন, যুদ্ধবিহীন মুক্তিযোদ্ধা এবং হালের চেতনাময় ফিল্টার তত্ত্বের তাত্বিক, তিনি তার এক প্রবন্ধে বলেছেন “স্বাধীনতার পর বিহারী রাজাকার হত্যার কথা মনে করে এখনো বেদনা অনুভব করেন”। চলুন তার লেখা থেকেই পড়ি;
“… ১৫ তারিখ রাতটি ট্রেঞ্চে এবং ঘরের ভেতরে ছোটাছুটি করে কাটিয়ে দিয়েছি। ১৬ তারিখ ভোরে আমরা সবাই অনুভব করতে শুরু করেছি বাংলাদেশের স্বাধীনতা সংগ্রাম দ্রুত একটি সমাপ্তির দিকে পৌঁছতে শুরু করেছে। রেডিওতে ক্রমাগত বলছে ‘হাতিয়ার ডাল দো’। কিন্তু পাকিস্তান মিলিটারিরা হাতিয়ার ‘ডাল’ দেওয়ার কোনো লক্ষণ দেখালো না….ঘন্টা দুয়েক পর হঠাৎ একটি বিচিত্র দৃশ্য দেখতে পেলাম। বিশাল কনভয় করে যে সব মিলিটারি গিয়েছে তারা ফিরে আসতে শুরু করেছে…দেখেই আমরা বুঝতে পারলাম ফিরে আসা এই সৈন্য হচ্ছে পরাজিত সৈন্য, পালিয়ে আসা সৈন্য। আমরা অবাক হয়ে দেখলাম মিলিটারি ট্রাকের মাঝে সাদা পোষাকের মানুষ, এই দেশের দালাল এবং রাজাকার। মিলিটারির আশ্রয়ে তারা পালিয়ে আসছে। একটু পরেই দেখতে পেলাম বিহারি পরিবার, নারী-পুরুষ, শিশু-কিশোর ভয়ার্ত মুখে ছুটে যাচ্ছে। স্বাধীনতা সংগ্রামে তারা ভুল দিকে অংশ নিয়েছিল, স্বাধীনতার পূর্ব মূহুর্তে তারা এখন ভয়ে-আতঙ্কে দিশেহারা। যুদ্ধের ৯ মাস তাদের অনেকে এই দেশের মানুষের ওপর কী ভয়ঙ্কর নির্যাতন করেছে, এই মূহুর্তে সেই অন্যায়ের প্রতিফলের আশঙ্কায় তাদের মুখ রক্তহীন-ফ্যাকাশে। মা ছোট শিশুকে বুকে চেপে ছুটে যাচ্ছে, উজ্জল কাপড়পরা কিশোরী বাবার পিছু পিছু ছুটে যাচ্ছে, তাদের চোখেমুখে কী ভয়ঙ্কর আতঙ্ক। স্বাধীনতার পর তাদেরকে কী ভয়ানক চড়া মূল্য দিতে হয়েছিল – সেই কথা মনে করে আমি এখনো এক ধরণের বেদনা অনুভব করি।
পরদিন খুব ভোরে আমি স্বাধীন বাংলাদেশে বের হয়েছি। যে মাটিতে পা দিচ্ছি সেটি একটি স্বাধীন দেশের মাটি…বাসা থেকে বের হয়ে কয়েক পা অগ্রসর হয়েছি তখন দেখলাম রিকশা করে দুজন মানুষ যাচ্ছে….গলায় গামছা দিয়ে তাকে বেঁধে রাখা হয়েছে… রিকশায় বসে থাকা মানুষ দুজন আমার দিকে তাকিয়ে ফর্সা মানুষটিকে দেখিয়ে বললো, ‘বিহারি রাজাকার’। রিকশাটা এগিয়ে গেল, একটু সামনেই একটা পুকুর, সেখানে এলাকার সব রাজাকারদের ধরে এনে জবাই করা হচ্ছে।
আমি যাত্রাবাড়ী থেকে হেঁটে হেঁটে ঢাকা শহরে এসেছি….মাঝে মাঝে ইতস্তত গুলির শব্দ। কিছু আনন্দ প্রকাশের গুলি, কিছু প্রতিহিংসার গুলি। হেঁটে যেতে যেতে পথেঘাটে মৃতদেহ ডিঙ্গিয়ে যেতে হলো, এই মৃতদেহগুলো নতুন, এগুলো দেশদ্রোহী রাজাকারের মৃতদেহ। বিহারিদের মৃতদেহ॥” – মুহম্মদ জাফর ইকবাল / কলামসমগ্র – ২ ॥ [ অনন্যা – ফেব্রুয়ারী, ২০১০ । পৃ: ১৯৮-১৯৯ ]
তো, নতুন করে যখন ৩০ লক্ষ নিয়ে আলোচনা-সমালোচনা শুরু হবে বলে মনে হচ্ছে,আমরা শুধু এটুকু আবেদন করতে চাই পক্ষ-বিপক্ষের সবার সংখ্যাটাই তুলে আনুন সঠিকভাবে। গন কবর থেকে উদ্ধারকৃত মাথার খুলিতে বিহারী-রাজাকার-পাকপন্থিদের খুলিও সংযুক্ত করুন। অন্যথায় ইতিহাসটা পরিপূর্ণ হয়না। পরিশেষে, ১৯৭১ ও তার পরে যারাই জীবন দিয়েছেন প্রত্যেকেই তার নিয়ত অনুসারে আল্লাহর কাছে উত্তম পুরষ্কার পান সেই দোয়া।