জামায়াতবাদের সংকট নিয়ে প্রথম পর্ব লেখার পর একটু দেরী হয়ে গেল ২য় পর্বটি লিখতে।বিভিন্ন ধরনের ব্যস্ততায় আর হয়ে উঠেনি।প্রথম পর্বে ৭১ নিয়ে জামায়াতের সংকট নিয়ে লিখেছিলাম,ঐ লেখাটারই আরেকটি পর্ব লেখার ইচ্ছা ছিল। কিন্তু ৭১ এত জটিল একটা বিষয় সেটা নিয়ে সম্ভবত দুই পর্বে পুরো বিষয়টা শেষ হত কিনা সন্দেহ।সেজন্য আপাতত সেদিকে না গিয়ে আমার দৃষ্টিতে বাদবাকী সংকটগুলো নিয়ে অল্প অল্প করে আলোচনা চালিয়ে যেতে চাই। দ্বিমত-তৃিমত সাদরে গ্রহনীয়,শুধু গালাগালি ছাড়া।
মানুষের উপর আস্থার সংকট
সাধারন মানুষের উপর জামায়াতিদের আস্থার সংকট ব্যাপক। জামায়াত-শিবিরের কর্মিরা তাদের দলের বিপক্ষে যে যাই বলুক উঠে পরে লেগে যায়, প্রয়োজনে গালাগালিও করে প্রতিক্রিয়া দেখায় কারন সাধারন মানুষের উপর তাদের আস্থা নেই বললে চলে। জামায়াত-শিবিরের কর্মিরা সাংগঠনিকভাবে এমন কালসারে গড়ে উঠেন যেখানে সংগঠনের বাহিরের মানুষের প্রতি এক ধরনের আস্থাহীনতায় ভোগেন। একই সংগঠনের ভেতরেই কর্মি-সাথী-সদস্যের মধ্যে যে লুকোচুরি ও গোপনীয়তার কালচার তারা তৈরি করেছে এবং যেটায় তারা অভ্যস্ত হয়ে পরেছে সেটা বাহিরের মানুষের সাথে যোগাযোগ, সম্পর্ক তৈরি ও প্রতিপালনের ক্ষেত্রেও যথেষ্ঠ প্রভাব বিস্তার করে। সমালোচক যাই বলুক হউক সেটা নায্য সমালোচনা-যা থেকে হয়ত নিজেদের কর্মকৌশলের পর্যালোচনা করা সম্ভব কিন্তু প্রতিক্রিয়াশীলতার কাছে সব চাপা পরে যায়।এমনকি তাদের নিজের দলীয় লোকদের সমালোচনাকেও তারা শত্রুর ন্যায় গ্রহন করে। উদাহরন সরূপ গত সেপ্টেম্বর মাসে ফরিদ আহমদ রেজা নামে শিবিরের একজন সাবেক সেক্রেটারী তার স্মৃতিচারন মুলক লেখা লিখেন।
স্মৃতিচারন মুলক ঐ লেখায় গালাগালির বন্যা বয়ে যায় ফলে বাধ্য হয়ে তাকে একটি আরেকটি বাড়তি পাদটিকা লিখে বলতে হয়েছে কেন তিনি এই সময়ে লেখাটি লিখলেন,এক পর্যায়ে ক্ষমাও চাইলেন। অথচ সাধারন মানুষের চোখে লেখাটা খুব গুরুত্বপূর্ণ কিনা সেটা বুঝার জন্য বাহির থেকে ভেতরে দেখার (Outside-in view) দৃষ্টিতে দেখলে দেখা যায় জনাব ফরিদ রেজার লেখার কার্যকারিতা (Utility) জামায়াত-শিবিরের আভ্যন্তরীন সংগঠনের বাহিরে খুব বেশি একটা নেই। জামায়াত শিবিরের নেতা-কর্মিরা মনে করেছে এই বুঝি তিনি দলের গোপন কথা বার্তা বাহিরে প্রকাশ করে দিলেন।আর সাধারন মানুষ তাদের এইসব জেনে জামায়াত-শিবিরের প্রতি মন্দ ধারনা করবে। সাধারন মানুষের প্রতি আস্থাহীনতাই এর কারন।
অনেকে হয়ত ধরে নিয়েছেন ভেতরের এইসকল কথাবার্তা জামায়াত বিরোধীদের হাতে অস্র হিসেবে ব্যবহৃত হবে,সেই ভয়-আশংকা থেকেও অনেকে প্রতিক্রিয়াশীল আচরন করেছে। অথচ বাস্তবতা হচ্ছে কোন জাতীয় গনমাধ্যম এই পর্যন্ত এই বিষয়ে কোন নিউজ প্রকাশ করেনি,এর কারন হচ্ছে তাদের কাছে এই লেখার কোন জাতীয় কার্যকারিতা (Utility) নেই। জামায়াত-শিবিরের অর্ধ-শিক্ষিত কর্মিদের বুঝার ক্ষমতা নেই যে, বিরুধী গনমাধ্যম তখনি জামায়াত বিষয়ক কোন বিষয়কে ফলাও করে প্রচার করে যখন সেটা দিয়ে জামায়াত-শিবির কর্মিদের মনোবল ভেঙ্গে দেয়া যায়। জনাব ফরিদ রেজার ঐ লেখার মাধ্যমে আভ্যন্তরীন সংস্কারের যে দাবী জামায়াতে পরিলক্ষিত হচ্ছে সেটা হয়ত আরো জোরালো হতে পারত যা কিনা দীর্ঘ মেয়াদে জামায়াতের পক্ষেই যেত।আর সেটা কেন চাইবে জামায়াত বিরোধী মিডিয়াগুলো?
সাধারন মানুষের উপর আস্থার সংকট থেকেই জামায়াত শিবিরকে সাপোর্ট না করলে একজন মুসলমান ‘ভাল মুসলমান নন’ এমন প্রান্তিক দৃষ্টিভঙ্গি দেখা যায় জামায়াতিদের মধ্যে-যেটা বাস্তবে খুবই ভয়ানক। এই অনাস্থার বাস্তব কারন যেমন রয়েছে তেমনি রয়েছে দার্শনিক কারনও যা নিয়ে বিস্তারিত গবেষণাও হতে পারে। জনাব ফরিদ রেজার লেখার কারনে সংগঠনের ভেতরের কথা সাধারন মানুষ জেনে গেছে এবং এর প্রভাব কর্মিদের উপর পরবে, কর্মিরা ভুল বুঝবে, হতাশ-নিষ্ক্রিয় হয়ে পরবে, সর্বোপরি সাধারন মানুষ জামায়াত-শিবিরের উপর আস্থা হারিয়ে ফেলবে এবং তাতে ইসলামের ক্ষতি হয়েছে এমন অজুহাতেও প্রতিক্রিয়া দেখা গেছে। জামায়াত শিবির কর্মিরা পুরো বিষয়কে সাংগঠনিক মেঝাঝে ভেতর থেকে বাহিরে (Inside-out view) দেখার কারনে এই প্রতিক্রিয়া দেখিয়েছেন।
আভ্যন্তরীন কালচারঃ অতিমাত্রায় গোপনীয়তার নীতি থেকে প্রতিক্রিয়াশীলতা
মানুষের প্রতি আস্থাহীনতা থেকেই জামায়াত-শিবিরের লোকদের মধ্যে সাংগঠনিকভাবে অতিমাত্রায় গোপনীয়তা রক্ষার কালচার তৈরি হয়েছে।এই নীতির কিছু কল্যাণকর দিক থাকলেও সামগ্রিক বিচারে অনেক ক্ষতিকর।এই নীতি এমন যে আভ্যন্তরীনভাবে সংগঠনের ভেতরেই নেতা-কর্মিরা একে অপরকে সন্দেহের দৃষ্টিতে দেখে। এখানে প্রত্যেক ক্যাডার(স্তর) এর জন্য আলাদা গোপনীয়তার নীতি পরিলক্ষিত হয়।একজন সদস্য (উচ্চ স্তর) সদস্য বৈঠকের কথা একজন সাথীকে (মাঝ স্তর) বলতে পারবেন না,একজন সাথী সাথী বৈঠকের কথা একজন কর্মিকে(নিন্ম স্তর) বলতে পারবেন না,আর একজন কর্মি সেটা সমর্থককে (সর্ব নিন্ম স্তর) বলতে পারবেন না।সামগ্রিকভাবে ভেতরের কথা বাহিরে বলা যাবেনা।এই ধরনের গোপনীয়তার চর্চা একজন কর্মিকে অন্ধ আনুগত্য করতে শেখায় কেননা তাকে বলা হয় “এটা উপরের লেবেলের কথা আপনার কাছে বলা যাবেনা”, এক্ষেত্রেও “শুনলাম আর মানলাম” কুরআনের আয়াত দিয়ে মানুষের জানার মৌলিক আগ্রহের বিরুদ্ধে একধরনের জোরপূর্বক মানতে বাধ্য করা হয়।
এই চর্চার সবচেয়ে ভয়ানক ফলাফল হচ্ছে এ পর্যন্ত শিবিরের কেন্দ্র থেকে জেলা সভাপতি পর্যায়ের কোন নেতা আজ পর্যন্ত নিজেদের কোন জীবনী লিখেছেন বলে আমাদের জানা নেই।ফলে কালপরিক্রমায় একটি সংগঠনের গতিশীলতার লক্ষ্যে বিভিন্ন পর্যায়ে সংগঠন যে কৌশল নিয়েছিল সেগুলো পর্যালোচনা করে,ভুল থেকে শিখে সংগঠনকে সামনে নিয়ে যাওয়ার জন্য কোন ধরনের পর্যালোচনার সুযোগ তৈরি হয়নি। জামায়াতের ক্ষেত্রেও একই কথা বলা চলে। শুধুমাত্র মরহুম গোলাম আযম ছাড়া কেউই আর জীবনী লেখার উদ্যেগ নেননি।
এই বিষয়টা আরেকটা সমস্যার তৈরি করেছে।জামায়াত-শিবির যেহেতু বাংলাদেশের সামগ্রিক রাজনীতি’র অংশীদার (stakeholder), তাদের নিয়ে বিভিন্ন দেশীয় ও আন্তর্জাতিক গবেষকদের গবেষণা করার সময় যখন তথ্য, উপাত্তের দরকার হয় তখন অধিকাংশে নির্ভর করতে হয় প্রতিপক্ষের লেখা বই, আর্টিকেল ও সংবাদের উপর যা বাস্তবিকভাবে পক্ষপাতদুষ্ট ও প্রোপাগান্ডার হাতিয়ার হিসেবে জামায়াতের বিরুদ্ধে ব্যবহৃত হয়। সাংগঠনিকভাবে এই ধরনের নীতি ও চর্চায় অভ্যস্ত জামায়াত-শিবিরের কর্মিরা যখন তাদেরই সাবেক একজন কেন্দ্রীয় সেক্রেটারী জেনারেল জনাব ফরিদ রেজার আত্নজীবনীমুলক লেখা অনলাইনে দেখতে পেলেন তখন গোপনীয়তার নীতি ভংগের অজুহাতেও তার বিরুদ্ধে অত্যন্ত নোংরা ভাষায় আক্রমণ করেছেন। এই নীতি সামগ্রিকভাবে প্রতিক্রিয়াশীলতা ও সংস্কারবিরোধীতার একটি অন্যতম কারনও।
প্রশ্ন হতে পারে, সাধারন মানুষের প্রতি আস্থার সংকট এবং সেটা থেকে প্রতিক্রিয়াশীলতা না হয় বুঝা গেল কিন্তু এর কারন কি? মানুষের প্রতি আস্থার সংকটই বা কেন তৈরি হল? এই প্রশ্নের দার্শনিক কারন খুঁজতে গেলে মাওলানা মওদুদীর কিছু দার্শনিক প্রস্তাবনাকে খুঁজে পাওয়া যাবে।দার্শনিক গভীরতার দিকে আপাতত না গিয়ে নিন্মে একটি আচরনগত কারন যা আমি খুঁজে পেয়েছি তুলে ধরছি, পরের পর্বে আরো কিছু আর্থ-সামাজিক ও আচরনগত কারন নিয়ে আলোচনা করার চেষ্টা করব।
আত্মিক সঞ্চয় হারানোর ভয়
জামায়াতের কর্মি সংগ্রহের মাধ্যম হিসেবে কাজ করে ইসলামিক থিওলজি (কুরআন, হাদীস) কিন্তু ফলাফল হচ্ছে রাজনীতি,এই জায়গাটাতে জামায়াত শিবির নেতা-কর্মিদের সাইকোলজি বুঝা জরুরী। কর্মিদের উদ্দোম ও কাজের মুল প্রনোদনাটা আসে ধর্ম থেকে, রাজনীতি থেকে না। ধর্ম মুসলমানের জীবনে গুরুত্বপূর্ন ভূমিকা পালন করে।ধর্মের মাধ্যমে দুনিয়াতে “আত্মিক সঞ্চয়” করে পরকালে চিরকালীন শান্তির জান্নাত পেতে চায় মুসলমানগন।কিন্তু এই আত্মিক সঞ্চয়ই ক্ষেত্র বিশেষে প্রতিক্রিয়াশীলতা তৈরি করতে পারে, করতে পারে কোন ধরনের পরিবর্তনের বিরুদ্ধে প্রতিবন্ধকতার সৃষ্টি। “আত্মিক সঞ্চয়” বিষয়টা বোঝার জন্য সংক্ষেপে আলোচনা করা প্রয়োজন।
সঞ্চয় হচ্ছে উদ্ভৃত্ত থেকে তিলে তিলে জমানো অর্থ,এটা অর্থনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি যা মানুষের মাঝে প্রবল।বিশ্বাসীদের কাছে ইবাদত, আমলকে এরকম সঞ্চয় হিসেবে গন্য করতে পারি।মুসলমানগন জন্ম থেকে যে যেই তরিকায় আমল করেছে, নামাজ-রোজা করেছে, ইবাদত করেছে…এগুলো কোথাও সঞ্চয় হচ্ছে এমন বিশ্বাস ঈমানদার মাত্রই পোষণ করেন এবং এগুলো একদিন আমাদের জন্য অফুরন্ত কল্যাণ বয়ে আনবে (বেহেশত)। এই সঞ্চয়কে আমরা বলতে পারি আত্মিক বা আধ্যাত্মিক সঞ্চয় বা পুন্য।
মুসলমানগন সহজে কেউ অন্য কারো মতামত সহজে মেনে নিতে রাজি নয়, কেননা অন্যের মতামত সত্য হলে এত দিন যে দলিলের উপর আমল করে আধ্যাত্মিক সঞ্চয় হয়েছে সেটা ভুল প্রমাণিত হয় অথবা সঞ্চয়ই হয়নি বলে প্রতিয়মান হয় অথবা তৈরি হয় হারানোর ভয় । যে আদর্শের ভিত্তিতে আমলনামা (সঞ্চয়নামা) তৈরি হয়েছে সেটা প্রশ্নবিদ্ধ হতে দেখলেই মানুষের অবচেতন মন পরিবর্তনে প্রতিবন্ধকতা (change resistance) সৃষ্টি করতে দেখা যায়। ব্যাপারটা হচ্ছে এমন, আমি যদি অন্যের মতামত নেই তাহলে আমি যে মতামতের ভিত্তিতে এতদিন আমল করে আসলাম (যা সঞ্চয় হয়েছে) সেটার কি হবে?
মুসলমানদের বিভিন্ন দল-উপদলের মাঝে রেশারেশির অন্যতম কারন হচ্ছে এই আত্মিক সঞ্চয় হারানোর ভয়! এই ভয়ে বিভিন্ন দল-উপদলগুলো নিজেদের মধ্যে প্রয়োজনীয় পরিবর্তনও আনতে চায়না। ক্ষেত্র বিশেষে, কেউ এমনো আছে যে সারা জীবন কাটিয়ে দিয়েছে একটা আদর্শকে ধারন করে,তাকে যদি বলা হয় আপনার আদর্শের গোড়াতেই রয়েছে গলদ তাহলে সে কিভাবে মেনে নেবে ব্যাপারটা?
জামায়াত-শিবিরের কর্মিদের রাজনৈতিক ট্রেইনিংয়ে সংকীর্ণ যে থিওলজিকাল রেফারেন্স ব্যবহৃত হয় সেগুলো তাদেরকে এতটাই সংকীর্ণ করে ফেলে যে, তারা পরবর্তীতে নিজের দলের লোকেরাও যখন আভ্যন্তরীন ভুলত্রুটিগুলো পরিবর্তনের লক্ষ্যে আওয়াজ তুলে তাদের বিরুদ্ধে উঠে পরে লাগে। এটাই হচ্ছে প্রতিক্রিয়াশীলতা তৈরির অন্যতম কারন এবং সেখান থেকে সংস্কার বিরোধীতা।কোন কর্মিই চাইবেনা তার আখেরাতের সঞ্চয় বরবাদ হয়ে যাক যার জন্য সে অনেক ত্যাগ স্বীকার করেছে।
(চলবে)
পরের পর্বঃ জামায়াতবাদের সংকট-৩ঃ সংস্কার প্রসঙ্গ