১) বি বাড়িয়ায় যে ঘটনা ঘটেছে, তাকে তুচ্ছ ঘটনা বলা সহজ নয়। একটা আবাসিক মাদরাসায় পুলিশ ও ছাত্রলীগের আক্রমণ, পিঠে ঠেকিয়ে গুলি এবং তিন তলা থেকে ফেলে দেয়ার মধ্য দিয়েই মাত্রা বুঝা যায়। নিছক মোবাইল ক্রয়-বিক্রয় সংক্রান্ত ঘটনা থেকে এর জন্ম নয়, এটা আমরা যে কেউ বুঝবো। শত বছরের পুরনো অরাজনৈতিক গণমানুষ সমর্থিত প্রতিষ্ঠানে আক্রমণ কোন অর্থেই জামাতি বা নিছক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে হামলার মত নয়। অবশ্য, যারা জামেয়া ইউনুসিয়ার সামাজিক অবস্থান ও সমর্থন বিষয়ে ওয়াকিবহাল নন, তাদের পক্ষে বুঝা খুব কঠিন। তাহলে হামলা কেন হয়েছিল?

২) সেকুলাররা নানাভাবে ঘটনাকে ব্যাখ্যা করেছে। ঢোল-তবলা-গাছ-খুনিদের নিস্ক্রিয়তায় আহাজারি। এটা খুবই স্বাভাবিক। হেফাজতের লংমার্চে এক শাহাবাগি সাংবাদিক মহিলা কি এক বাজে মন্তব্য করায় জনতা ক্ষেপে উঠে। তবে, কয়েকজন ছেলে তাকে বাঁচায় এবং নিরাপদ দূরত্বে সরিয়ে দেয়। সেই ছেলেদের মধ্যে আমাদের একজন বন্ধুও ছিল। পরে, ঐ মহিলাকে নানা জায়গায় হাজির করা হয়।সে নানা ধরণের বিদ্বেষপূর্ণ মন্তব্য করে। পরে, এই মহিলা আমরিকা সরকারের কাছ থেকে পুরস্কার গ্রহণ করে। এ সব নিয়ে একদিন আমাদের সেই বন্ধু দুঃখ করছিল।একবার আমাদের কষ্টের একটু কৃতজ্ঞতাও প্রকাশ করলনা। লাখ লাখ মুসলমান মারা দেশের কাছ থেইকা পুরস্কার নিল। বন্ধুর চোখ অশ্রুতে চিকচিক করছিল।
যে মানুষের মধ্যে নৈতিকতার ছিটে ফোটাও নেই। বিদেশে যাবার জন্য নিজেদের হিটলিস্ট যারা বানায়ে পত্রিকায়-দূতাবাসে পাঠায়,নিজের বন্ধুদের হত্যা করতে পরিকল্পনা করে, তাদের কথা আমরা কেন ধরবো ভাবা দরকার!
৩) জামেয়া ইউনুসিয়াসহ বিবাড়িয়ায় ট্র্যাডিশনাল ধর্মীয় মূল্যবোধ ও ক্ষমতা অত্যন্ত সক্রিয়। উদাহারণ দিলে বুঝা যাবে; যে কোন ঘটনা অপছন্দ হলে বিবাড়িয়ায় মাদরাসার ছাত্ররা সরাসরি থানায় গিয়ে প্রতিবাদ জানায়। তাবলীগ জামাতের উপর আক্রমণ হওয়ার প্রেক্ষিতে ছাত্ররা সে এলাকায় গিয়ে মোকাবেলা করেছিল, শহরের কেন্দ্রে এনজিও বা মাজারি-ইসলামের কোন প্রভাব বিস্তারের প্রধান বাধা তারাই।কাদিয়ানিদের ধর্মীয় বিস্তারের মুখেও তাদের শক্ত অবস্থান। গেল বছর টর্নেডোর পর সেনাবাহিনীর সাথে উদ্ধার কাজে তারাই প্রধানত সক্রিয় ছিল, স্কুল-কলেজের ছেলেরা তাদের অধীনে কাজ করেছে। অথচ, এই ধর্মীয় ক্ষমতা আওয়ামীলীগ ও তার নেতাদের ছেড়ে কথা বলেনি। বর্তমান রাষ্ট্রের ইসলাম বিরোধী অবস্থানের শক্ত প্রতিবাদ করেছে। ফলে আওয়ামীলীগ তাদের শত্রু ধারণা করতে শুরু করে। বিশেষত .২০০১ ও ২০০৯ এর সরকার বিরোধী আন্দোলনের প্রধান সূত্রমুখে এই ধর্মীয় ক্ষমতার ভূমিকার দুঃখস্মৃতি আওয়ামীলীগ ভালোভাবেই মনে রেখেছে।
তো,গত কদিন আগে এক মন্ত্রীর আদেশে দুইটি মাদরাসা বন্ধ হবার পর সরাসরি সরকার বিরোধী প্রতিবাদে হাজির হয় এই ধর্মীয় অংশ।যেহেতু ধর্মীয় ইস্যুতে সরকার বিরোধীতা, সেহেতু সরকারি দল ও পুলিশের পক্ষে সরাসরি এই প্রতিবাদের বিরোধীতা করা সম্ভব না,ফলে মোবাইল-তর্কের মারফত মাদরাসায় আক্রমণ করা হয়।সেই থেকে হত্যা এবং পরের দিনের সহিংসতা। এখানে গুরতর তিনটে প্রশ্ন খাড়া হয়!
৪) সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও আইন নানা ক্ষেত্রে নানা সীমাবদ্ধতা দেখা দেয়। সরকার মোকাবেলায় নিজস্ব নিয়ন্ত্রণ ভুল-ব্যবহার করছে, আইনও ব্যর্থ। এবং হত্যার পরেও সরকারি নিয়ন্ত্রণ ও আইনের মাধ্যমে মীমাংসায় যাওয়া যায়নি। চেষ্টা চালানো হয়েছে। তবে, বাধ্য হয়ে সহিংসতার মাধ্যমেই মীমাংসা এসেছে। এটা গুরতর, রাষ্ট্রের নিয়ন্ত্রণ ভেঙ্গে পড়ার প্রাথমিক আলামত।সে ভাঙ্গনকে তরান্বিত করতে ও তার পুনর্গঠন করতে সহিংসতা জরুরি হয়ে পড়ছে। প্রশ্ন হচ্ছে, সেদিনের সহিংসতার কি কোন সম্ভাবনা আছে?
৫) বলা জরুরি, যেভাবে সহিংসতা হয়েছে, তা অনেক অর্থেই সমর্থনযোগ্য নয়। এমন অনেক জায়গায় হামলা হয়েছে, ক্ষতি করা হয়েছে যাকে ইসলামি অর্থে কোনভাবে সমর্থন করা যায়না। কেউ হয়তো বলবেন, কলেজ-ভার্সিটি-গার্মেন্টসে এই ধরণের প্রতিক্রিয়া নিয়মিতই দেখা যায়। রাজনৈতিকভাবে এইসব ঘটনা খুবই হচ্ছে। তবে, এসব কিছু মেনে নিলেও সহিংসতার ধরণকে কখনই সমর্থন করা যায়না। নৈতিকতা স্থান-কালের ভেদে পৃথক হতে পারেনা, হলে সেটা নৈতিকতা নয়। আফসোস, কোরআন-হাদিস পড়া ছেলেরাও এমন সহিংসতা করবে?
আমরা কিন্তু প্রচুর মিছিল করেছি। তবুও, কখনো আমাদের মাদরাসা, শ্রেণী বা ব্যক্তি আমির বিরুদ্ধে এই অর্থে সহিংসতার অভিযোগ করা যাবেনা।এটা স্রেফ অনৈতিকতা ও বিশৃঙ্খলা। আমাদের কয়েকজন বন্ধুর সাথে কথা বলেছিলাম, এমন হল কেন? বিশৃঙ্খলা করা ছেলেরা মাদরাসার আদব- আয়তনের মাধ্যমে ততটা প্রভাবিত নয়। এই নিয়ন্ত্রণহীনতা নানা সময়ে নানা বিশৃঙ্খলাও ঘটাচ্ছে। তাহলে, সমস্যা কোথায়?
৬) এটা খুবই পরিষ্কার যে, রাষ্ট্রীয় পুনর্গঠন ও নিয়ন্ত্রণের জন্য সহিংসতা-ক্ষমতা জরুরি। আধুনিক রাষ্ট্রকে যেভাবে সংজ্ঞায়িত করা হয়, সহিংসতার বৈধতার মালিকানার ক্ষমতা। ফলে, এই একক সহিংসতা এবং সে সংক্রান্ত নৈতিকতা যখন শুধু বাংলাদেশেই নয় সব দেশেই ভেঙ্গে পড়ছে। তখন বিনির্মাণ ও স্বাধীনতা রক্ষার জন্য সহিংসতা জরুরি। তবে, যে ধরণ ও প্রকৃতির সহিংসতা আমরা বিবাড়িয়ায় দেখেছি, তাকে দিয়ে খুব বেশি আশাবাদী হবার সুযোগ নেই। নিয়ন্ত্রণ, পরিচালনা, নৈতিকতাহীন সহিংসতা খুব একটা কাজে দেবেনা।
বন্ধুদের মারফত জানতে পারলাম, বিবাড়িয়ায় মেধাবী ছেলেরা খুব একটা পরিচালনায় আসেনি। হুজুরদের পক্ষ থেকেও ঐ অর্থে সমর্থন ছিলনা। যার ফলে বিশৃঙ্খলা।
বিবাড়িয়াকে অভিনন্দন জানাচ্ছি এবং মনে রাখছি, তাদের ভুল-শুদ্ধি থেকে নানা কিছু শেখার সুযোগ আছে!
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ…..
আপনার পর্যবেক্ষণ ও মূল্যায়নটি গুরুত্ববহ
জাযাকাল্লাহ