[‘মক্তব’ পাঠচক্রের ১৩তম পর্বে এই বিষয়ে আলোচনা হয়। বাংলা সাহিত্যে মুসলিম অবদানকে সঠিকভাবে পাঠ করার প্রয়োজনীয়তা উপলব্ধি থেকেই এই বিষয়কে বাছাই করা হয়েছিল। আলোচনার সংক্ষিপ্তসার নিয়েই এই লেখাটি প্রস্তুত করা হয়েছে। ১ম কিস্তির পর।]
বাংলা সাহিত্যে মুসলিম অবদান (১ম কিস্তি)
১৭৫৭ ঈসায়ীতে পলাশী যুদ্ধে বাংলার ভাগ্য-বিপর্যয়ের ফলে বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও সংস্কৃতির ক্ষেত্রে যে বিশাল ক্ষতি সাধিত হয় তা জাতীয় পর্যায়ে অন্য যে কোন ক্ষতির চেয়ে কোন অংশে কম নয়। এতোদিন পর্যন্ত শাসক ও অভিজাত শ্রেণীর লোকদের আশ্রয়ে ও পৃষ্ঠপোষকতায় কবি-শিল্পী-সাহিত্যিকগণ সাহিত্য চর্চায় নিয়োজিত ছিল। কিন্তু পলাশীর ষড়যন্তমূলক যুদ্ধে ইংরেজদের ক্ষমতা দখলের পর স্বাভাবিকভাবে বাংলার রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক, সামাজিক, সাহিত্য-সংস্কৃতি তথা সামগ্রিক ক্ষেত্রে সমূহ বিপর্যয় সৃষ্টি হয়। কবি-সাহিত্যিক ও বিদগ্ধ সংস্কৃতিসেবীগণ অকস্মাৎ পৃষ্ঠপোষকহীন, অসহায়, ছিন্নমুল মানুষে পরিণত হয়। জনগন সর্বদা ইংরেজ ও তাদের এদেশীয় অনুচরদের নানারূপ অত্যাচার, অর্থনৈতিক শোষণ, সামাজিক পীড়ন ও জুলুমের আশংকায় সদা চিন্তান্বিত থাকতো। এরূপ উদ্ধেগাকুল পরিবেশ সাহিত্য-সংস্কৃতি বিকাশ কখনো সম্ভব নয়।
প্রথমত ইংরেজ বেনিয়াগণ ব্যবসা-বাণিজ্যের উদ্দেশ্যে এদেশে আগমন করে। কিন্তু অর্থ-লিপ্সা ক্রমে রাজনৈতিক আধিপত্য লাভের আকাঙ্ক্ষায় রূপান্তরিত হয়। আর এদেশীয় কিছু বিশ্বাসঘাতক স্বার্থপর ব্যক্তি তাদের এই উচ্চাকাঙ্ক্ষা বাস্তবায়নের জন্য সাহায্য করে। এখানেও আমরা ইতিহাসের বিকৃতি দেখতে পাই বাংলার বর্ণবাদী ঐতিহাসিকদের থেকে। বিশ্বাসঘাতকতার সাথে শুধুমাত্র মীর জাফর শব্দটা সমার্থক হয়ে গেছে তাদের কল্যাণে। অথচ বাংলার স্বাধীনতা ইংরেজদের হাতে তুলে দেওয়ার জন্য মীর জাফর যতোটা দায়ী, রাজা রাজবল্লভ, মানিক চাঁদ, ঊমি চাঁদ, নবকিষেণ, জগৎশেঠ, রায়দুর্লভ, কৃষ্ণচন্দ্র, কৃষ্ণদাস তার চেয়ে বেশি দায়ী। প্রকৃত ইতিহাস ও ষড়যন্ত্রের (বিস্তারিত)
এভাবে বেনিয়া শ্রেণীর ইংরেজগণ যখন তাদের এদেশীয় অনুচরদের সহযোগিতায় ছলে-বলে-কৌশলে রাজনৈতিক ক্ষমতা লাভে সক্ষম হলো, তখন তাদের নিকট থেকে কল্যাণ-বুদ্ধিসম্পন্ন কোন সুশাসন প্রত্যাশা করা দুরাশা মাত্র। ইংরেজ বেনিয়ারা নবলব্ধ রাজশক্তিকে অর্থনৈতিক শোষণের নিষ্ঠুরযন্ত্রে পরিণত করে। এইরূপ অর্ধশত বছর অত্যাচার-শোষণ চালানোর পর তারা উপলব্ধি করে যে, রাজনৈতিক আধিপত্য স্থায়ী করতে হলে তাদের দুটি কাজ করতে হবে-
একঃ এদেশের মানুষকে মানসিক দিক দিয়ে তাদের গোলামে পরিণত করতে হবে। ফলে তারা এদেশে এক শ্রেণীর রাজানুগত মানুষ তৈরির উদ্দেশ্যে ইংরেজী ভাষা ও শিক্ষা পদ্ধতি চালু করে ও ইংরেজী সভ্যতা-সংস্কৃতির ব্যাপক প্রসার ঘটাবার প্রয়াস পায়। এদেশের মানুষকে তাদের দেশের মানুষের মতো জ্ঞানী-গুনী, শিক্ষিত-বিদ্ধান করে তোলার মহৎ উদ্দেশ্য তারা ইংরেজী ভাষা ও শিক্ষা ব্যবস্থা চালু করেনি, বরং এদেশীয় একশ্রেণীর মানুষকে তাদের অনুগত দাসে পরিণত করাই এর লক্ষ্য ছিল। যার প্রমাণ লর্ড ম্যাকলের শিক্ষা কমিশনের প্রস্তাবনায় বলা হয়েছিল “ বর্তমানে আমাদের এমন একটি শ্রেণী গড়ে তুলতে হবে, সমাজে যারা শাসক ও শাসিতের মাধ্যে দোভাষীর কাজ করবে। তারা রক্ত-মাংসের গড়নে ও বর্ণে ভারতীয় হবে বটে, কিন্তু রূচি, চিন্তা ও মননের দিক থেকে হবে খাঁটি ইংরেজ।“
দুইঃ এদেশের মানুষ শতাব্দীর পর শতাব্দী একসাথে মিলেমিশে বসবাস করে আসছে। তারা ভিন্ন ধর্মে বিশ্বাসী হলেও একে অন্যের বিপদে এগিয়ে আসে। জাতীয় স্বার্থে সবাই এক সূরে কথা বলে। তাই এখানে শাসন ক্ষমতা টিকিয়ে রাখতে হলে উভয়ের মাঝে বিভেদ তৈরি করতে হবে, এক কে অন্যের শত্রু করে তুলতে হবে। এই লক্ষ্যে তারা তাদের বিখ্যাত থিওরি “Divide and Rule” প্রয়োগ করলো এবং ইতিহাস বিকৃতি করে মুসলিম সুলতানদের হিন্দুদের উপর অত্যাচারী হিসেবে চিত্রায়িত করলো। অথচ আমরা দেখতে পাই প্রায় সব সুলতানদের আমলেই রাজ্যের অনেক গুরুত্বপূর্ণ পদে হিন্দুরা ছিলেন এমনকি সেনাপতিও ছিলেন। এভাবেই কুটকৌশল, ষড়যন্ত্র, বিভেদ ও হিন্দুদেরকে কাছে টেনে নিয়ে তারা এদেশের রাষ্ট্র ক্ষমতা ও শোষণ টিকিয়ে রাখতে প্রয়াস পায়।
ইংরেজদের প্রবর্তিত নব্য শিক্ষা-সভ্যতা একশ্রেণীর মানুষের মধ্যে যথেষ্ট উৎসাহ-উদ্দীপনা লক্ষ্য করা গেলেও সাধারণ জনগণ বিশেষত মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষা-সংস্কৃতির বিকাশ চরমভাবে বাধাগ্রস্থ হলো। হিন্দুরা এটাকে রাতারাতি ভাগ্য বদলের সুযোগ হিসেবে গ্রহণ করলো। ফলে নতুন প্রবর্তিত শিক্ষা-সভ্যতা অনুসরণ-অনুকরণে তারা দ্রুত এগিয়ে আসে। আর মুসলমানরা পড়ে পিছিয়ে। এ প্রসঙ্গে ইংরেজ লেখক উইলিয়াম হান্টার তাঁর ‘দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস’ গ্রন্থে বলেন- আমাদের প্রবর্তিত শিক্ষা ব্যবস্থা হিন্দুদেরকে শতাব্দীর নিদ্রা থেকে জাগিয়ে তুলতে পারলেও তা ছিল মুসলমানদের ঐতিহ্য পরিপন্থী, তাদের চাহিদার সাথে সামঞ্জস্যহীন এবং তাদের ধর্মের কাছে ঘৃণার্হ। …. আমাদের প্রবর্তিত জনশিক্ষা ব্যবস্থা যেমন তাদের নিকট গ্রহণযোগ্য হয়নি, তেমনি তাদের নিজস্ব ব্যবস্থা টিকিয়ে রাখার জন্য যে আর্থিক সাহায্য তারা এতোকাল তারা পেয়ে আসছিল, তাও আমরা বিনষ্ট করেছি। (দি ইন্ডিয়ান মুসলমানস-১৫৪,১৬০)
কারণ, নিজস্ব গৌরবময় ঐতিহ্য, রাজ্য-হারানোর বেদনা ও বিগত দিনে দীর্ঘস্থায়ী ক্রুসেডের তিক্ততার কারনে ফিরিঙ্গি শিক্ষা-সভ্যতা-সংস্কৃতি ও ভাষাকে মুসলমানগণ কিছুতেই সহজভাবে গ্রহণ করতে পারেনি। মুসলমানগণ মানসিকভাবে ইংরেজ শাসন মেনে নিতে না পারায় এবং দীর্ঘকাল পর্যন্ত হারানো রাজশক্তি ফিরে পাবার আকাঙ্ক্ষা মনে মনে পোষণ ও এ জন্য যুদ্ধ-বিগ্রহে লিপ্ত থাকে। মীর কাসিম থেকে শুরু করে ফকির-সন্ন্যাসী বিদ্রোহ, টিপু সুলতান, সৈয়দ আহমদ বেরেলভী, তিতুমীর, হাজী শরিয়তুল্লাহ, দুদু মিয়ার আন্দোলনের ভিতের উপর ভিত্তি করে এই উপমহাদেশ মহাবিদ্রোহের জন্য তৈরি হয়। অত্যাচার, নির্যাতন, শোষণ, নিপীড়নে জর্জরিত হয়ে জনগনের মাঝে চরম অসন্ত্রোষ বিরাজ করছিল এবং তার সাথে মুসলমানদের অব্যাহত স্বাধীনতা আন্দোলনে অনুপ্রাণিত হয়ে সমগ্র ভারতের সিপাহীরা ১৮৫৭ সালে মোগল সম্রাট দ্বিতীয় বাহাদুর শাহকে রাজা ঘোষণা দিয়ে মহাবিদ্রোহে ঝাপিয়ে পড়ে। (বিস্তারিত এখানে )
তাদের আন্দোলনে ইংরেজ সম্রাজ্যের ভিত কেঁপে উঠে। হিংস্র ইংরেজরা হায়েনার মতো নৃশংসভাবে এ সমস্ত বিদ্রোহ দমন করে। প্রহসনের বিচারের মাধ্যমে সবাইকে মৃত্যুদন্ড ও ফাঁসি দেওয়া হয়। একেকজনকে কামানের মুখে বেঁধে কামান দিয়ে ছিন্নভিন্ন করে শহীদ করা হয়, গাছের ডালে ফাঁসিতে ঝুলিয়ে রাখা হয় এবং সেখান থেকে সৈনিকদের গোশত গলে গলে পড়ে গেলেও কঙ্কালগুলোকে ঝুলিয়ে রাখা হতো ভীতি সৃষ্টি করার জন্য। ঢাকার বাহাদুর শাহ পার্ক সে স্মৃতির কথাই বলে। ইংরেজ বিরোধী স্বাধীনতা সংগ্রামে লিপ্ত থাকায় মুসলমানগণ কেবল সামাজিক সুযোগ-সুবিধা ও আধিপত্য হারিয়েছে তাই নয়, শিক্ষা-দীক্ষার ক্ষেত্রেও অনেক পিছিয়ে যায়। মূলতঃ ১৮৫৭ সনে মহাবিদ্রোহের (সিপাহী বিদ্রোহ) পূর্ব পর্যন্ত এ অবস্থার কোন পরিবর্তন হয়নি। মহাবিদ্রোহ ব্যর্থতা বরণ করায় এবং অদূর ভবিষ্যতে বড় কোন বিদ্রোহ বা অভ্যুত্থানের আয়োজন করার সম্ভাবনা তিরোহিত হওয়ায় মুসলমানদের রাজনৈতিক আধিপত্য লাভের আকাঙ্ক্ষা সাময়িকভাবে নস্যাৎ হয়ে যায়। এরপর থেকে গত্যন্তর না দেখে মুসলমান সমাজের কেউ কেউ ইংরেজদের প্রবর্তিত শিক্ষা-দীক্ষা অনুসরণে উদ্যোগী হয়। মুসলমাগণ যখন এগিয়ে আসে ইতোমধ্যে পুরো একশতাব্দীকাল অতিবাহিত হয়ে গেছে এবং ততোদিনে শিক্ষাগত, সামাজিক, অর্থনৈতিক প্রভৃতি সকল ক্ষেত্রে মুসলমানদের অবস্থা খুবই শোচনীয় হয়ে পড়েছে।
অন্যদিকে হিন্দুদের হারাতে হয়নি কিছুই। এটা ছিল তাদের নিকট শুধু প্রভু বদল মাত্র। বরং তাদের মধ্যে একশ্রেণীর স্বার্থপর লোক এ পরিবর্তন আগে থেকেই প্রত্যাশা করে আসছিল এবং সমস্ত ষড়যন্ত্রের ইন্ধন দিয়ে ইংরেজদের ক্ষমতার রাস্তা দেখিয়ে আসছিল। যাদের আলোচনা আগে হয়েছে। তাই তাদের নিকট এটা একান্ত প্রত্যাশিত ছিল। এটাকে তারা রাতারাতি ভাগ্য বদলের সুযোগ হিসাবে গ্রহণে রীতিমত তৎপর হয়ে ইংরেজ প্রবর্তিত শিক্ষা-সভ্যতা অনুসরণ-অনুকরণে দ্রুত এগিয়ে আসে। সুতরাং তারাই প্রশাসন, সেনাবাহিনী, ব্যবসা-বাণিজ্য, জমিদারী-জোতদারী ও সামাজিক বিভিন্ন ক্ষেত্রে ক্ষমতা হাতে পায় এবং মুসলমানদের উপর চরম মাত্রায় নির্যাতন শুরু করে। বিংশ শতাব্দীর শুরুতেও যার প্রমাণ মেলে আবুল মনসুর আহমদের “আমার দেখা রাজনীতির পঞ্চাশ বছর” বইতে।
ইংরেজ আগমনের সাথে সাথে সাহিত্য-সংস্কৃতি চর্চায় বিঘ্ন সৃষ্টি হয়। হতাশাগ্রস্থ সামাজিক পরিবর্তনের বিশৃঙ্খল পটভূমিতে শিল্প-সাহিত্যের বিকাশ সম্ভব ছিল না। ফলে পলাশী যুদ্ধের পর প্রায় এক শতাব্দীকাল পর্যন্ত বাংলা সাহিত্যে কোন উল্লেখযোগ্য অবদান চোখে পড়ে না। বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সেন আমলকে যেমন “তমসা যুগ” বলা হয় ঠিক তেমনি এ যুগকে ‘নিস্ফলা যুগ’ বলা যায়। তবে সেন আমলের মতো এ যুগটি ততোটা তমসাচ্ছন্ন ছিল না। ঊনবিংশ শতাব্দীর শুরুতেই সামাজিক অস্থিরতা ও মানসিক বৈরাগ্য ও দৈন্য ভাব আস্তে আস্তে কাটতে থাকে তবে তা শুধুমাত্র বাঙালী হিন্দু সমাজের মাঝে সীমাবদ্ধ। ১৮০০ সালে ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ও ১৮১৭ সালে হিন্দু কলেজ স্থাপিত হওয়ায় বাঙালী হিন্দু সমাজের মাঝে নবজাগরনের সূচনা হয়। ফোর্ট মানে দুর্গ। সত্যিই মুসলমান শক্তিকে দুর্বল করার জন্য ঐ ফোর্টে বহু সৈন্য তৈরি হয়, যাদের হাতিয়ার কামান, গোলা নয়; বিষাক্ত কালো কালি আর সরকাঠি অথবা পালকের কলম ছিল।
ইংরেজ প্রবর্তিত “Divide and Rule” এর বাস্তবায়নের জন্য ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ছত্রছায়ায় ইংরেজ পাদ্রী ও ব্রাহ্মণ সংস্কৃত পন্ডিতদের যৌথ প্রচেষ্টায় বাংলা ভাষার রূপ পরিবর্তনের প্রয়াস চলে। আরবি-ফার্সি-উর্দু ভাষার অসংখ্য শব্দরাজি যা বিগত কয়েকশত বছর ধরে বাংলা ভাষার সাথে মিলেমিশে বাংলা ভাষার শব্দভাণ্ডারকে সমৃদ্ধ করে তুলেছিল, সেগুলোকে ‘মুসলমানি জবান’ রূপে আখ্যায়িত করে বাংলা ভাষা থেকে ঝেটিয়ে তাড়িয়ে তার পতিবর্তে খাঁটি দুর্বোধ্য ও অপ্রচলিত সংস্কৃত শব্দরাজিতে পূর্ণ করে ‘সংস্কৃতের দুহিতা’ নতুন কৃত্রিম বাংলা চালু করা হয়। এ কৃত্রিম ভাষায় পাঠ্য বই রচনা করে শিক্ষিত শ্রেণীর মাঝে রাতারাতি এটা গ্রহণযোগ্য করে তোলার চেষ্টা করা হয়। অধিকাংশ হিন্দু লেখক যথাসাধ্য এ নতুন ‘সংস্কৃত বাংলায়’ সাহিত্য চর্চার প্রয়াস পায়। একে সর্বজন গ্রহণযোগ্যতা দেওয়ার জন্য উঠে পড়ে লাগে। রামমোহন রায়, মাইকেল মধুসুধন দত্ত, ইশ্বরচন্দ্র গুপ্ত, প্যারীচাঁদ মিত্র,দেবেন্দ্রনাথ, ইশ্বরচন্দ্র বিদ্যাসাগর, দীনবন্ধু মিত্র, বিহারী লাল, হেমচন্দ্র প্রমূখের ন্যায় কবি-সাহিত্যিকগণ এ ভাষায় সাহিত্য চর্চা করে এ ভাষাকে সর্বজনগ্রাহ্য করে তোলেন।
বাংলা ভাষা, সাহিত্য ও রাজনীতির প্রবাদ পুরুষ আবুল মনসুর আহমদ বলেন- এই সংস্কারকরা আমাদের চৌদ্দ পুরুষের মুখাগ্নি করিয়া তাদের মুখের খানা কে খাদ্য, গোশতকে মাংস, আন্ডাকে ডিম, সালুনকে ব্যঞ্জন, সুরুয়াকে ঝোল, বরতনকে থাল, নওলা- লুকমাকে গ্রাস করিয়া ফেলিয়াছেন। গোসলের বদলে এরা আমাদের স্নান করাইতেছেন। আমাদের বাড়ির বিলাইকে বিড়াল, কুত্তাকে কুকুর আর আমাদের চালের কাউয়াকে কাক করিয়া ফেলিয়াছেন। আমাদের সমাজের আদব-কায়দা ও তমিয- লেহাযকে শিষ্টাচার ও বিনয়-নম্রতায় উন্নত করিয়াছেন। আমাদের মেহমানদের দাওয়াত না করিয়া এরা অতিথিদের নিমন্ত্রণ করিতেছেন। (বাংলাদেশের কালচার, পৃ-১২৯)
গোলাম আহমদ মোর্তজা সাহেব লিখেন- “১৭৭৩ সালে ইংরেজদের নিয়ামক আইন সৃষ্টি ও কার্যকরি হবার পরেই আরবি, ফারসি হত্যার খড়গ তথা হিন্দু-মুসলমানদের মৈত্রি ছেদনে অস্ত্র তৈরির কারখানা ঐ দুই প্রতিষ্ঠান ফোর্ট উইলিয়াম কলেজ ও শ্রীরামপুর মিশন ও তার সঙ্গে বিলাতি প্রেসটির চাকা ঘুরিয়ে আমাদের মগজ গুড়িয়ে পরিবেশ যখন অনুকূল হয়ে উঠলো তখনই আইনের সাহায্যে ১৮৩৮ সালে দেশময় ঘোষণা করা হলো যে, সরকারি আদালত, শহর বা গ্রামে কোথাও পারসি ভাষার ব্যবহার চলবে না। ব্যবহার চলবে ইংরেজী আর বাংলার, কিন্তু মাতৃহারা সন্তানেরা যে অবস্থা হয় পারসি, আরবিকে হারিয়ে নবোদ্ভূত বাংলার অবস্থাও হল তদ্রূপ শ্রীহীন।“ (ইতিহাসের ইতিহাস, পৃ-৪৯)
এই পুরোটা সময় জুড়ে মুসলিম ব্যক্তি জীবন থেকে শুরু করে সামাজিক, ধর্মীয়, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক এমনকি মুসলিম জীবনের কোন দিকই সাহিত্যে আলোচিত হয়নি যদিওবা একটু হয়েছে তা তাদেরকে ব্যঙ্গ করে বা তুচ্ছ-তাচ্ছিল্যের সাথে খুবই নেতিবাচকভাবে হয়েছে। বঙ্কিম ছিল এদের মধ্যে সর্বাগ্রণ্য। এমনকি রবীন্দ্রনাথের মতো একজন ব্যক্তিও এই অবস্থা থেকে মুক্ত ছিলেন না। আবুল মনসুর আহমদ তাঁর একই বইয়ে বলেন- বাংলার বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথের কাব্যের আকাশে শুধু শরতের চন্দ্র উদিত হইত এবং সে চন্দ্রোদয়ে ‘আনন্দময়ীর আগমনে আনন্দে যাইত দেশ ছেয়ে।’ কিন্তু সে কাব্যাকাশে ঈদ-মোহরমের চাঁদ কখনও উঠিত না। ঈদের আনন্দে ও মোহরমের শোকে দেশ কখনও ছেয়ে’ও যাইত না। এই সাহিত্যের আলোকের প্রখরতায় মুসলিম বাংলার নিজস্ব সাহিত্য ‘বটতলার পুঁথি সাহিত্য’র বদনাম লইয়া পল্লী-বাংলায় মুখ লুকাইল। ঈশ্বরগুপ্ত ও বঙ্কিমচন্দ্র ‘নেড়ে যবন’ গাল দিয়া মুসলিম বাংলাকে সেই যে সাহিত্যের মজলিস হইতে তাড়াইলেন, রবীন্দ্র শরৎচন্দ্রের সাহিত্যের বিরাট আকর্ষণী শক্তিও আর তাদেরে সে মজলিসে ফিরাইয়া আনিতে পারিল না। (বাংলাদেশের কালচার)
ঊনবিংশ শতকের শেষার্ধে মুসলমানদের নবজাগরণ ও সাহিত্য চর্চার প্রয়াস প্রধানতঃ হিন্দুদের বিদ্ধেষমূলক প্রচারণা ও চরম বিদ্বিষ্ট আঘাতেরই প্রত্যক্ষ ফল। মুসলমানগণ যখন সাহিত্যাঙ্গনে আসলেন তখন ভাষা, ভাব সবই হিন্দুদের দখলে। মুসলমানগণ এসে তাদের ভাষাতেই সাহিত্য চর্চা করতে হলো। তারপরও তারা মুসলমানদের এই আগমনকে ভাল চোখে দেখল না। নানারূপ কথা বলতে থাকলো- মুসলমানরা বাংলা লিখতে জানেনা, তাদের লেখা অপাঠ্য ইত্যাদি ইত্যাদি। এ প্রসঙ্গে মহাকবি কায়কোবাদের উক্তি প্রণিধানযোগ্য – হিন্দু লেখকগণ আমাদিগকে বিশেষ ঘৃণার চক্ষে দেখিতেন, তাহারা বলিতেন, ‘মুসলমান বাংলা লিখিতে জানে না’। এসব শুনিয়া আমার মনে বড়ই আঘাত লাগিত, বলিতে কি হিন্দুদের ঐসব শ্লেষ উক্তি আমার হৃদয়ে বিষম বাজিত। মীর মোশাররফ হোসেন এই সময় ‘জমিদার দর্পণ’ ও ‘বসন্ত কুমারী’ নাটক লিখার পর নিন্দার ঝড় বয়ে যায়। এরপরও তিনি ‘এর উপায় কি’ প্রহসন লিখলে সে সময় ‘বান্ধব’ সম্পাদক রায় কালীপ্রসন্ন ঘোষ বিদ্যাসাগর C.I.E. বাহাদুর ঘৃণা ও তাচ্ছিল্যের সহিত লিখিয়াছেন, “এসব আগাছা সাহিত্যের উদ্যান হইতে কাটিয়া ফেলাই উচিত”। আরও লিখিয়াছেন, ‘এর উপায় কি’? শুধু মীর সাহেবকে এইরূপ বিদ্রুপ করিলে প্রাণে এত বাজিত না। মুসলমান জাতিকে লক্ষ্য করিয়া এসব কটুক্তি করাতে বড়ই মর্মাহত হইয়াছিলাম। বলিতে কি, উহারা কোন বহি হাতে লইয়া মুসলমান গ্রন্থকারের নাম দেখিলেই ফেলিয়া দিত। বিস্তারিত
ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে মুসলিম জাতীয় জাগরণের সূত্রপাত হয়। এ সময় যে সমস্ত কবি-সাহিত্যিক বাংলা ভাষা আকাশে উদিত হয়ে আমাদের জাতীয় জাগরণ ও আশা-অভীপ্সার কথা তাদের সাহিত্যে রুপায়িত করেন তাঁদের মধ্যে বিশিষ্ট কয়েকজন হলেন- মীর মোশাররফ হোসেন, মোহাম্মদ কাজেম আল কোরেশী ওরফে কায়কোবাদ, শেখ আব্দুর রহিম, শেখ রিয়াজউদ্দীন আল মাশহাদী, মোজাম্মেল হক (নদীয়া), মোহাম্মদ নজিবর রহমান সাহিত্য-রত্ন, মুনশী মেহের উল্লাহ, মোহাম্মদ রেয়াজ উদ্দীন আহমদ, মোজাম্মেল হক (বরিশাল), আব্দুল করিম সাহিত্য-বিশারদ, আব্দুল গফুর সিদ্দিকী, মতিউর রহমান খান, মাওলানা মনিরুজ্জামান ইসলামাবাদী, মাওলানা মোহাম্মদ আকরাম খাঁ, রোকেয়া সাখাওয়াত হোসেন, সৈয়দ ইসমাইল হোসেন সিরাজী, সৈয়দ এমদাদ আলী, একরাম উদ্দীন, শেখ ফজলুল করীম, ডক্টর মোহম্মদ শহীদুল্লাহ, মোহাম্মদ এয়াকুব আলী চৌধুরী, মোহাম্মদ নাসির উদ্দিন, এস ওয়াজেদ আলী, ডা লুৎফুর রহমান, শাহাদৎ হোসেন, কাজী আব্দুল ওদুদ,শেখ মোহাম্মদ ইদ্রিস আলী, গোলাম মোস্তফা, ওয়াজেদ আলী, আবু কালাম শামসুদ্দীন, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, আবুল মনসুর আহমদ, কাজী নজরুল ইসলাম, ফররুখ আহমদ প্রমুখ।
উপরোক্ত বিশিষ্ট ব্যক্তিবর্গ কেউ কেউ ঊনবিংশ শতকে সাহিত্য-চর্চা শুরু করলেও তাঁদের অধিকাংশের সাহিত্য চর্চার সূত্রপাত বিংশ শতকের গোড়ার দিকে। তবে নজরুলের আবির্ভাবের পর থেকে তিনিই ছিলেন এঁদের সকলের মধ্যমণি। আমাদের জাতীয় জাগরণ, ভাষার ঐতিহ্য পুনরুদ্ধার, সাংস্কৃতিক স্বাতন্ত্র্য ও জাতীয়-ধর্মীয় চেতনার প্রধান উদ্গাতা হলেন নজরুল ইসলাম। বিশ শতকের দ্বিতীয় দশকের শেষ প্রান্তে তাঁর বণাঢ্য আবির্ভাব। নজরুল ঘুমন্ত, অধঃপতিত মুসলিম জাতির প্রাণে একদিকে নতুন প্রাণের সঞ্চার করলেন, অন্যদিকে তেমনি মুসলমানদের ছয়শো বছরের গৌরবময় ভাষা-সাহিত্যের ঐতিহ্য, শব্দসম্পদ, ভাব, বিষয়, বাগধারা ইত্যাদি সবকিছুর আধুনিক রুপায়ন ঘটালেন। নজরুল বাংলা সাহিত্যে যে স্বতন্ত্র প্রাণবন্ত ধারার সৃষ্টি করেন, চল্লিশের দশকে সেই ধারার মূল প্রাণ-পুরুষ হলেন ইসলামী রেনেসাঁ ও ঐতিহ্যের কালজয়ী অমর শিল্পী কবি ফররুখ আহমদ। তাঁদের হাত ধরেই প্রাণ ফিরে পেয়েছে আমাদের প্রাণপ্রিয় এই বাংলা ভাষা।