[প্রথম কিস্তিতে আমরা বাংলা ভাষার উদ্ভব, বিকাশ, প্রাচীন ও মধ্যযুগ, মুসলমানদের অবদান, ইতিহাস বিকৃতকরণ প্রভৃতি সম্পর্কে আলচনা করেছি এবং দ্বিতীয় কিস্তিতে বাংলা সাহিত্যের আধুনিক যুগ, ইংরেজ-ব্রাহ্মণদের বাংলা বিকৃতকরণ, সাহিত্যাঙ্গন থেকে মুসলিমদের বিতাড়ন, ভাষাভিত্তিক মুসলিম জাতীয়তাবাদের বিকাশ প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করেছি। এই কিস্তিতে আমরা বাংলা সাহিত্যের বর্তমান প্রেক্ষাপট, বিজাতীয় সাংস্কৃতিক আগ্রাসন, বাংলাদেশী মুসলিমদের আত্মপরিচয়ের সংকট, উত্তরণের উপায় প্রভৃতি নিয়ে আলোচনা করবো।]
নদী যেমন বাঁকে বাঁকে মোড় নিয়ে পাহাড়-উপত্যকা পেড়িয়ে বিভিন্ন জনপদ, বনজঙ্গল-সমতল বেয়ে সমুদ্রে মিলিত হয়, সাহিত্যও তেমনি নানা পথ, সমাজের ভাঙ্গা-গড়া, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট, জীবনের বিচিত্র অভিজ্ঞতার বন্ধুর পথ পাড়ি দিয়ে নিজস্ব পথ ও পরিচয় খুঁজে নেয়। সুদূর অতীতকে বাদ দিয়ে শুধুমাত্র বিগত পাচ-ছয় দশকের প্রবাহমান ধারার দিকে তাকালে আমাদের সাহিত্যের বিচিত্র পট-পরিবর্তন ও বিভিন্ন প্রভাব সহজেই লক্ষ করা যায়। চল্লিশের দশকে পাকিস্তান আন্দোলন যখন তুঙ্গে তখন সাহিত্যে জাগরণমূলক চেতনা, নিজস্ব আদর্শ, ঐতিহ্য ও স্বতন্ত্র ভাব-দ্যোতনা সুস্পষ্ট রূপ লাভ করে। দীর্ঘকাল থেকে বিদেশী ইংরেজের শাসন-শোষন-বঞ্চনা, হিন্দুদের বিদ্বেষপূর্ণ মনোভাব, ১৯০৫ সনে বঙ্গভঙ্গ, ১৯০৬ সনে মুসলিম লীগের প্রতিষ্ঠা, ১৯১১ সনের বঙ্গভঙ্গ রদ, ১৯২১ সনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠা ইত্যাদি একের পর এক ঘটনামালা আমাদের জাতীয় জাগরণের মূলে যেমন কাজ করেছে, আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির স্বতন্ত্র ধারা ও স্রোত প্রবাহ নির্মাণেও তেমনি তা গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
জাতীয় জাগরণের ক্ষেত্রে আমরা উপলব্ধি করি, হিন্দুদের থেকে সর্বদিক দিয়ে আমরা একটি স্বতন্ত্র, আলাদা জাতি এবং এই প্রবল আত্মোপলব্ধির কারণেই এক স্বতন্ত্র, স্বাধীন রাষ্ট্র-সত্তা প্রতিষ্ঠার তাগিদে আমরা অর্থাৎ সর্বভারতীয় মুসলমান ঐক্যবদ্ধভাবে পাকিস্তান সৃষ্টির কাজে সর্বাত্মক আত্মনিয়োগ করি। এই সময়ে আমরা এটাও উপলব্ধি করি যে, এক ভাষা-ভাষী হলেও বাঙালি মুসলমান ও বাঙালি হিন্দুর চিন্তা-চেতনা, ঐতিহ্য-সংস্কৃতি, জাতীয় আশা-আকাঙ্খা ও স্বপ্ন-সাধনা সবই স্বতন্ত্র। এমনকি, বহুক্ষেত্রে তা সাংঘর্ষিক। ভাষার ক্ষেত্রেও ভাষা-সম্পদ, উপমা, প্রতীক, রূপকের ব্যবহার এমনকি, অভিব্যঞ্জনা ও দ্যোতনার ক্ষেত্রেও তা স্বতন্ত্র। এ কারনেই মুসলিম প্রধান বাংলাদেশ ও হিন্দু প্রধান পশ্চিমবঙ্গের বাংলা ভাষার মধ্যে স্বাতন্ত্র্য বিদ্যমান।
নজরুল বাংলা সাহিত্যে যে স্বতন্ত্র প্রাণবন্ত ধারার সৃষ্টি করেন, চল্লিশের দশকে সেই ধারার মূল প্রাণ-পুরুষ হলেন ইসলামি রেনেসাঁ ও ঐতিহ্যের কালজয়ী কবি ফররুখ আহমদ। তাঁর সমসাময়িক কবি-সাহিত্যিকদের মাঝে যারা এই ধারাকে নানাভাবে উজ্জীবিত ও অব্যাহত রেখেছেন তারা হলেনঃ মওলানা মোহাম্মদ আকরম খাঁ, শাহাদৎ হোসেন, গোলাম মোস্তফা, আবুল মনসুর আহমদ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, মুজিবুর রহমান খাঁ, কবি বেনজির আহমদ, বেগম সুফিয়া কালাম, তালিম হোসেন, কবি মোফাখখারুল ইসলাম, সৈয়দ আলী আহসান, আবুল হাশেম, মঈনুদ্দীন, শাহেদ আলী, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, আজিজুর রহমান, আশরাফ সিদ্দিকী, মোহাম্মদ মাহফুজ উল্লাহ, আব্দুস সাত্তার প্রমুখ। তবে চল্লিশের দশকে আমাদের সাহিত্যের মূলধারার পাশাপাশি আরো দুটি ক্ষীণ ধারার অস্তিত্ব বিদ্যমান ছিল- একটি সমন্বয়বাদী এবং অন্যটি সমাজতান্ত্রিক ধারা। তবে চল্লিশের প্রবল জাতীয়তাবাদী চেতনা ও স্বাধীনতা আন্দোলনের উচ্চ কলরোলে এ দুটি ধারার কোনটিই মুসলিম সমাজ-মানসে তেমন প্রভাব বিস্তার করতে পারেনি।
সমন্বয়বাদী চিন্তা-চেতনার মূল উদ্ভাবক ছিলেন রাজা রামমোহন রায় আর তার প্রধান সহযোগী ছিলেন রবীন্দ্রনাথের পিতা দেবেন্দ্রনাথ ঠাকুর। ইংরেজী শিক্ষা-সভ্যতার প্রভাবে ইংরেজী শিক্ষিত হিন্দুরা অনেকেই খ্রিষ্টান ধর্ম গ্রহণ করতে থাকে। তাই হিন্দু ধর্মকে রক্ষা করার জন্য হিন্দুধর্মের পৌত্তলিকতা, জাতিভেদ প্রথা, নানা কু-প্রথা ও আচার-অনুষ্ঠান বাদ দিয়ে উপনিষদের হিন্দুধর্ম, বৌদ্ধ, খ্রিষ্টান ও ইসলাম ধর্মের সমন্বয়ে রামমোহন রায় ‘ব্রাহ্মধর্ম’ নামে এক নতুন ধর্মমত সৃষ্টি ও তার প্রবর্তন করেন। তাঁদের এই প্রচেষ্টায় হিন্দু-সম্প্রদায়ের ব্যাপকভাবে খ্রিষ্টান ধর্মে দীক্ষিত হওয়া বন্ধ হলেও ব্রাহ্মধর্ম তেমন বিস্তার লাভ করেনি। তবে হিন্দুধর্মের শিক্ষিত সম্প্রদায়ের একটি উল্লেখযোগ্য সংখ্যক লোকের চিন্তা-চেতনায় এর প্রভাব লক্ষ করা যায়।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর নিজেও ‘এক দেহে লীন’ হওয়ার এই চিন্তাধারার একজন প্রধান প্রবক্তা ছিলেন। মোহন চাঁদ করম চাঁদ গান্ধীও এই আদর্শ লালন করেন। মুসলিম জাতীয়তাবাদী চেতনা ও ইসলামি আদর্শের কারণে এই চিন্তাধারা দীর্ঘকাল মুসলিম সমাজে প্রবেশ করতে পারেনি। ১৯২৬ সালে ঢাকায় ‘মুসলিম সাহিত্য সমাজ’ গঠিত হয়। রামমোহন রায় ছিলেন সমিতির আদর্শ ব্যক্তিত্ব এবং তার সমন্বয়বাদী চিন্তাধারা ছিল সমিতির মূল লক্ষ্য। কাজী আব্দুল অদুদ, আবুল হোসেন, কাজী আনোয়ারুল কাদির, কাজী মোতাহার হোসেন, আব্দুল কাদির, আবুযযোহা নূর মোহাম্মদ, দিদারুল আলম প্রমুখ ছিলেন এই সমিতি নেতৃত্বের অগ্রভাগে। মুসলিম সমাজে এই চিন্তাধারা তেমন প্রভাব ফেলতে পারেনি। পরবর্তিতে চল্লিশের দশকে পাকিস্তান আন্দোলন শুরু হলে কংগ্রেসের সহযোগিতায় এই চিন্তা-চেতনা আবার মাথাচাড়া দিয়ে উঠে, যার একটা ক্ষীণ প্রবাহ চল্লিশের দশকে লক্ষ্য করা যায়।
চল্লিশের দশকে আরও একটি ধারার ক্ষীণ প্রবাহ আমাদের সাহিত্যে পরিলক্ষিত হয়- সেটা কমিউনিজম বা সমাজতন্ত্রের প্রভাব। রাশিয়ায় সমাজতান্ত্রিক বিপ্লব সংঘটিত হওয়ার পর তাঁদের চিন্তা-চেতনা বাংলাদেশেও প্রবেশ করে। তবে নাস্তিক্যবাদী এই ধারা বাংলার মাটিতে কখনোই সুবিধা করতে পারেনি। কৌশল হিসেবে এরা সবসময় সমন্বয়বাদীদের সাথে হাত ধরাধরি করে পথ চলতে থাকে। চল্লিশের দশকে তাই এদের একটা ক্ষীণ প্রভাব আমাদের সাহিত্যে দেখা যায়। ইসলামি রেনেসাঁর কবি ফররুখ আহমদও প্রথম জীবনে বামপন্থী আন্দোলনের সাথে জড়িয়ে পড়েন কিন্তু এই আদর্শের প্রতি মোহ-মুক্তি ঘটতে তাঁর বিলম্ব ঘটেনি। চল্লিশের দশকে মুসলিম জাতীয়তাবাদী ইসলামী মূলধারার পাশাপাশি উপরোক্ত দুটি ধারার প্রভাবও আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতিতে কম-বেশি লক্ষণীয়।
পাকিস্তান সৃষ্টির পর আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে কয়েকটি নতুন মাত্রা যোগ হয়। উল্লেখযোগ্য কয়েকটি হলো-
এক. বাঙালি মুসলমানদের কয়েকশো বছরের সাধনার ফসল যাকে বটতলার সাহিত্য, দোভাষী পুঁথি সাহিত্য, মুসলমানী বাংলা সাহিত্য ইত্যাদি তুচ্ছাত্মক শব্দে বলা হতো এবং ফোর্ট উইলিয়াম কলেজের ব্রাহ্মণ শিক্ষকরা যে ভাষাকে বিলুপ্ত করে দিতে চেয়েছিল- পাকিস্তান সৃষ্টির পর আমাদের এই সমৃদ্ধ ভাষা ও সাহিত্যের প্রতি নতুন করে আগ্রহ সৃষ্টি হয়।
দুই. তারা নতুন রাষ্ট্রগঠন ও স্বাধীনতা লাভের উদ্দীপনায় ইসলামি আদর্শ ও ভাব-চেতনায় ব্যাপক স্ফূর্তি লাভ করে। আত্মপ্রত্যয় ও সাহসী বিশ্বাসে বলীয়ান হয়ে নিজেদের সাহিত্য-সংস্কৃতি বিনির্মানে ঝাপিয়ে পড়ে। রবীন্দ্রনাথ, কলকাতাকে বাদ দিয়ে ঢাকাকে কেন্দ্র করে নতুন নতুন পত্র-পত্রিকা, বই-পুস্তক, নাট্যচর্চা ও সাংস্কৃতিক কার্যক্রম শুরু হয়। দীর্ঘকাল ধরে অবহেলিত-অবজ্ঞাত বাংলাদেশের মানুষের জীবনচিত্র, দুঃখ-বেদনা, আনন্দ-হাসি-কান্না, ইতিহাস-ঐতিহ্য, স্বপ্ন-কল্পনা ইত্যাদি নিয়ে রচিত হয় গল্প-কবিতা, নাটক-নভেল, ছড়া-ব্যঙ্গ এবং আরো বিচিত্র সাহিত্যের ভূবন। কবিতার ক্ষেত্রে সর্বাধিক উজ্জ্বল ও উদ্দীপনাপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন ফররুখ আহমদ, গোলাম মোস্তফা, তালিম হোসেন, সৈয়দ আলী আহসান, সুফিয়া কামাল, আহসান হাবীব, সানাউল হক, মোফাখখারুল ইসলাম, আবুল হোসেন, বেনজীর আহমদ, আবুল হাশেম,মঈনুদ্দীন,মোহাম্মদ মাহফুজউল্লাহ, আব্দুর রশীদ খান, আব্দুস সাত্তার, মতিউল ইসলাম প্রমুখ। কথাশিল্পে আবুল ফজল, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, শাহেদ আলী, সৈয়দ ওয়ালিউল্লাহ, শওকত উসমান প্রমুখ। প্রবন্ধ ও রস-রচনায় মওলানা আকরম খাঁ, ডক্টর মুহম্মদ শহীদুল্লাহ, আবুল কালাম শামসুদ্দিন, আবুল মনসুর আহমদ, মোহাম্মদ বরকতুল্লাহ, মুজিবুর রহমান খাঁ, ডক্টর মুহাম্মদ এনামুল হক, অধ্যক্ষ ইব্রাহিম খাঁ, আব্দুল হাই, সৈয়দ আলী আহসান, অধ্যাপক মনসুর উদ্দিন প্রমুখ। নাটকে নূরুল মোমেন, আসকার ইবনে শাইখ, মুনীর চৌধুরী প্রমুখ।
এ প্রসঙ্গে বিশিষ্ট নাট্যাভিনেতা ও লেখক ওবায়দুল হক সরকারের মন্তব্য প্রাণিধানযোগ্য- “মঞ্চ ছিল হিন্দুদের দখলে। মঞ্চে প্রবেশ করতে হলে হিন্দু হয়ে প্রবেশ করতে হত। মঞ্চে এতোকাল চরিত্রগুলো ধূতি-নামাবলি জড়িয়ে ‘জয় মা কালী’ বলে এসেছে, দর্শকদের চোখ-কান তাতেই অভ্যস্ত, হঠাৎ করে পায়জামা-পাঞ্জাবী, টুপি পরিহিত চরিত্র দেখলে চোখে ধাক্কা খাওয়ার কথা। আমি ১৯৪৪ সালে পশ্চিমবঙ্গের বাকুড়া শহরে প্রথম মঞ্চে পদার্পণ করি। দেশ ভাগের পূর্বে ও পরেও কিছুকাল ধূতি-নামাবলী জড়িয়ে মঞ্চে উঠে ‘দূর্গা’ ‘দূর্গা’ করেছি। আসকার ইবনে শাইখই প্রথম সুযোগ করে দিলেন মুসলমান হয়ে মঞ্চে প্রবেশ করার।“
তিন. পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পরপরই ভাষা আন্দোলনের সূত্রপাত হয়। ভাষা আন্দোলন আমাদের জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে এক সুদূরপ্রসারী ভূমিকা রাখে। ১৯৪৭ সালের পয়লা সেপ্টেম্বরে গঠিত ‘তমদ্দুন মজলিশে’র নেতৃত্বে যে ভাষা সচেনতা গড়ে ওঠে ক্রমান্বয়ে তা ভাষা-আন্দোলনের রূপ ধারণ করে এবং বায়ান্নর ফেব্রুয়ারিতে চরম আত্মত্যাগের মাধ্যমে তার চূড়ান্ত পরিণতি ঘটে। ভাষা আন্দোলনের সফল পরিণতি লাভের পর পরবর্তীকালের সকল আন্দোলনে এর প্রভাব ব্যাপক ভূমিকা পালন করে। রাষ্ট্রভাষা ও শিক্ষার মাধ্যম হিসেবে বাংলা ভাষার স্বীকৃতি, বাংলা একাডেমি প্রতিষ্ঠা, বাংলা ভাষায় বিভিন্ন পাঠ্য-পুস্তক প্রণয়ন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন, শিক্ষা আন্দোলন, আইয়ুব বিরোধী আন্দোলন, কপ, পিডিপি, ছয়দফা, ১৯৬৯ এর গণ-অভ্যুত্থান, সর্বশেষ স্বাধীন,স্বার্বভৌম বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠাতেও তার প্রভাব লক্ষ করা যায়। প্রথমাবস্থায় ভাষা আন্দোলনের নেতৃত্বের পুরোভাগে ছিলেন পূর্বোক্ত মূলধারার অগ্রবর্তী ব্যক্তিগণ।
পরবর্তীতে এ আন্দোলন ব্যাপক গণভিত্তি লাভ করার সাথে সাথে সর্বশ্রেণীর মানুষ এতে শামিল হয়। ফলে সমন্বয়বাদী ও সমাজতন্ত্রীগণও এগিয়ে আসেন এবং আস্তে আস্তে এমন অবস্থা সৃষ্টি হয় যে, উড়ে এসে জুড়ে বসা লোকেরাই এর সকল কৃতিত্ব ও সুফল ভোগ করতে থাকে। সেই সুবাদে সাহিত্য-সংস্কৃতির অঙ্গনেও মধ্য-পঞ্চাশ থেকে সমন্বয়বাদীগণ এবং তাদের ছত্রছায়ায় সমাজতন্ত্রীগন বিশেষ তৎপর হয়ে উঠে। যে হিন্দু-কংগ্রেস প্রথম থেকেই মুসলমানদের স্বাধিকার আন্দোলন ও স্বতন্ত্ররাষ্ট্র প্রতিষ্ঠার চরম বিরোধিতা করে এসেছে, তারাই সাহিত্য-সংস্কৃতির মাধ্যমে মুসলমানদের মূলভিত্তি আদর্শ, স্বতন্ত্র সংস্কৃতি ও জাতিসত্ত্বার বিরুদ্ধে সূক্ষ্ম, সুচতুর ও সুদূরপ্রসারী ষড়যন্ত্র শুরু করে ফোর্ট উইলিয়ামী বাংলা পুনরায় প্রতিষ্ঠা করে আবার আমাদের আত্মপরিচয়ের সংকটে ফেলে দেয়।
পাকিস্তান সৃষ্টির মূলে যে নব জীবন, সুখী-সুন্দর ভবিষ্যত গঠনের প্রত্যাশা ও স্বপ্ন-কল্পনা ছিল তা আদর্শহীন, নৈতিকতাবিবর্জিত, স্বার্থপর নেতৃত্বের কারণে অচিরেই তা ভেঙ্গে চুরমার হয়ে যায়। ফলে সকলের মধ্যেই বিশেষ করে তরুণদের মধ্যে একধরণের বিরূপ প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়, হতাশা ও বিভ্রান্তির শিকার হয় অনেকে। হতাশা থেকে আসে অবক্ষয়, মূল্যবোধের নিদারুণ সংকট এবং পাশ্চাত্যের প্রভাবে অশ্লীলতা ফুটে উঠে। । ষাটের দশকের সাহিত্যে তার পরিচয় পাওয়া যায়। ষাটের দশকে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে আর একটি নতুন মাত্রা যোগ হয় রবীন্দ্রনাথকে কেন্দ্র করে।
১৯৬০ সনে রবীন্দ্র জন্ম শতবার্ষিকী উদযাপনকে কেন্দ্র করে সমন্বয়বাদীরা রবীন্দ্র-প্রশস্তি ও রবীন্দ্র-স্তব-স্তুতির এক অভূতপূর্ব প্রবণতা প্রদর্শন করে এমন কি, রবীন্দ্রনাথকে তারা ‘আমাদের সাংস্কৃতিক সত্তার অবিচ্ছেদ্য অংশ’ বলে দাবি করে। এতে ইসলামি আদর্শ-ঐতিহ্য ও জাতীয়তাবাদী চেতনায় উদ্বুদ্ধ সচেতনমহল স্বভাবতই প্রতিবাদমুখর হয়ে উঠে। তারা রবীন্দ্রনাথকে বড় কবি, এমনকি বাংলা সাহিত্যের শ্রেষ্ঠকবি হিসেবে মর্যাদা দানে দ্বিধা না করলেও বেদ-উপনিবেশের দর্শনে প্রভাবিত রবীন্দ্রনাথকে আমাদের হাজার বছরের লালিত গৌরবান্বিত ঐতিহ্য-সংস্কৃতির অবিচ্ছেদ্য অংশ হিসেবে মানতে রাজী নয়। এ মতবিরোধের কারণে ষাটের দশকে সাহিত্য-সাংস্কৃতিক চিন্তায় দুটি সুস্পষ্ট ধারা বিদ্যমান। এখনো যে এ দ্বন্দ্বের অবসান হয়েছে তা বলা যায় না। রবীন্দ্রনাথকে নিয়ে এবনে গোলাম সামাদের বিশ্লেষণধর্মী একটি কলাম এই লিংকে
বাংলাদেশের স্বাধীনতা আন্দোলন ও স্বাধীন, স্বার্বভৌম বাংলাদেশের অভ্যুদয় ইতিহাসের এক অতি স্মরণীয় ঘটনা। এর ফলে আমাদের রাজনৈতিক, সামাজিক, সাংস্কৃতিক ও সাহিত্যের ক্ষেত্রে এক অনিবার্য পরিবর্তন ও প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়। দীর্ঘ নয় মাস রক্তক্ষয়ী সংগ্রামের পর ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বর বাংলাদেশের স্বাধীনতার নতুন সূর্য উদিত হয়। স্বাধীনতা সংগ্রামে প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নৈতিক, সামরিক, বস্তুগত ও অন্যান্য সহযোগিতা থাকার কারণে সমন্বয়বাদীরা জাতীয় জীবনের সর্বক্ষেত্রে একাধিপত্য লাভ করে। সে সুযোগে তারা প্রতিবেশী রাষ্ট্রের জাতীয় সংগীত রচয়িতা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের একটি পুরনো গানকে (যা কিনা এই বাংলার বিরুদ্ধে লিখা হয়েছিল-বঙ্গভঙ্গের বিরোধিতা করে) বাংলাদেশের জাতীয় সংগীতে পরিণত করে। আমাদের শিক্ষা, সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রেও এ সময় সমন্বয়বাদী সেক্যুলার তথা ইসলামবিরোধী ভাবধারা প্রবলভাবে বিস্তার লাভ করে। এরপর থেকেই সমন্বয়বাদী ও সমাজতন্ত্রীরা মিলে আমাদের তথাকথিত ‘বাঙালি’ করে তোলার মিশনে আদাজল খেয়ে নেমে পড়ে। বাঙালি সংস্কৃতি বলে তারা পশ্চিমবাংলার হিন্দুয়ানী সংস্কৃতিকে আমাদের উপর চাপিয়ে দেয়ার চেষ্টা করছে।
মিলাদ শরীফ, মোনাজাত বাদ দিয়ে মঙ্গল প্রদীপ, মঙ্গল শোভাযাত্রা চালু করা হয়েছে, জাতীয় সংস্কৃতির উৎস সন্ধান করতে গিয়ে মনসার গান, শিবের গাজন, ঢাকের বাদ্য, কাঁসার ঘন্টা, শঙ্খ, উলুধ্বনি, আলপনা, ধূতি প্রভৃতিকে আমাদের সংস্কৃতির অঙ্গীভূত কারার চেষ্টা চলছে। পথে পথে মূর্তি তৈরি করে মসজিদের নগরী ঢাকার গৌরবকে ম্লান করা হচ্ছে। ভাষাভিত্তিক সংস্কৃতি ও জাতীয়তাবাদের কথা বলে এদেশের শিল্প-সংস্কৃতিকে আর্য-মুম্বাই মডেলে ব্যাভিচারী শিল্প-সংস্কৃতিতে রূপদানের চেষ্টা চলছে। এমতাবস্থায় সাহিত্য, সংস্কৃতি ও শিল্পকলার স্বাভাবিক বিকাশ বাধাগ্রস্থ হয়। জাতীয় ক্রান্তিকালে স্বাধীন, সুস্থ চিন্তা-চেতনা, মূল্যবোধের অবক্ষয় তথা জাতীয় মূলধারার বিলুপ্তির আশংকা দেখা দেয়। পরবর্তীতে আশির দশকে একদল আদর্শবাদী, ঐতিহ্য-সচেতন কবি-সাহিত্যিকের আবির্ভাব ঘটে, যারা কুয়াশার কালো মেঘ কাটিয়ে নতুন আশা, উৎসাহ ও প্রত্যাশা জাগিয়ে তোলে। এদের মধ্যে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য- খন্দকার আশরাফ হোসেন, আশরাফ আল দীন, আব্দুল হাই শিকদার, আল মাহমুদ, মোশাররফ হোসেন খান, মতিউর রহমান মল্লিক, আব্দুল হালিম খাঁ, মুকুল চৌধুরী, সোলায়মান আহসান, তমিজ উদ্দীন লোদী, ফরিদ কবির, বুলবুল সরওয়ার, খসরু পারভেজ, আসাদ বিন হাফিজ প্রমূখ।
নব্বইয়ের দশকের শুরুতে কমিউনিজমের জন্মভূমি সোভিয়েত রাশিয়াসহ সমগ্র পূর্ব ইউরোপে সমাজতন্ত্রের পতন ও ক্ষুদ্র,নিরস্ত্র আফগান মুজাহিদদের হাতে সোভিয়েতের আপমানজনক পরাজয়ে রাশিয়া ভেঙে টুকরো টুকরো হয়ে গেলে আমাদের দেশের সমাজতন্ত্রীদেরও স্বপ্ন-সাধ ভেঙে চুরমার হয়ে যায়। নিজেদের আদর্শ ও লক্ষ্য সম্পর্কে হতাশ হবার ফলে সমন্বয়বাদীদের ছত্রছায়ায় ইসলাম-বিরোধী ভূমিকা পালন করতে থাকে বিশেষভাবেঃ সাহিত্য-সংস্কৃতি-সাংবাদিকতা, লেখক, বুদ্ধিজীবী, ও ছাত্র-যুবকদের মধ্যে তারা এ ভূমিকা অব্যাহত রাখছে। এ নেতিবাচক ভূমিকা আমাদের সমাজে, বিশেষভাবে সাহিত্য-সংস্কৃতির ক্ষেত্রে স্পষ্ট বিভাজন, পরষ্পরের প্রতি অবিশ্বাস ও জাতীয় আদর্শ ও মূল্যবোধের প্রতি সংশয় সৃষ্টি করছে।
এছাড়া নব্বইয়ের দশকে সীমান্তের ওপার থেকে অশ্লীল, অনৈতিক সাহিত্যের সয়লাব, চরিত্র বিধ্বংসী জাতীয় চেতনা বিরোধী সস্তা বই এনে বাজার ছেয়ে ফেলে। উপরন্তু, আমাদের কাগজ-শিল্পে কৃত্রিম সংকট সৃষ্টি করে, কাগজের মূল্য অসম্ভব বৃদ্ধি করে প্রকাশনা শিল্পকে ধ্বংস করার ষড়যন্ত্র করা হয়। এ অসুস্থ, নৈরাজ্যকর, সংকটকালে পশ্চিমা রুশদির মতো এখানেও তসলিমা নাসরিনদের আবির্ভাব ঘটে। তসলিমা নাসরিন ও একদল কবি-সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী-সাংবাদিক দেশি-বিদেশি কিছু সংখ্যক পত্রিকায় ও লেখায় উদ্দেশ্য-প্রণোদিত মহলের উস্কানি ও মদদে নবি-রাসূল-আযান ও ইসলামি আক্বিদা-বিশ্বাসের বিরুদ্ধে যখন চরম বিষদ্গার করতে থাকে তখন এদেশের জাতীয় আদর্শ ধারণকারী আপামর জনতা গর্জে উঠে। এতে জমাটবাঁধা কুয়াশা কিছুটা দূরীভূত হয়। এরপরও একটি রাজনৈতিক ছত্রছায়ায় এ অপশক্তি সাহিত্য-সংস্কৃতিক অনুষ্ঠান, নানাবিধ সভা-সেমিনারের নামে প্রতিবেশী রাষ্ট্র থেকে অসংখ্য কবি-সাহিত্যিক, শিল্পী ভাড়া করে এনে আমাদের সাহিত্য-সংস্কৃতি ও জ্ঞান-চর্চার কেন্দ্রগুলোকে বিজাতীয় ভাবধারা ও চিন্তা-চেতনাকে কুলষিত করে তোলে। যার ফলে বাঙালি সংস্কৃতির নামে, সেক্যুলারিজম বা ধর্মনিরপেক্ষ নামে ব্রাহ্মণ্যবাদ বা হিন্দুয়ানী সংস্কৃতি আমাদের উপর চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে জগদ্দল পাথরের মতো। আমাদের সংস্কৃতি আজ বুকের উপর পাথরচাঁপা নিয়ে ধুঁকে ধুঁকে মৃত্যুর প্রহর গুনছে। এখন তারা আমাদের সুস্পষ্ট জাতিগত বৈশিষ্ট্য ও স্বতন্ত্র আদর্শ-ঐতিহ্যিকে মুছে ফেলে আমাদের স্বাধীনতা স্বার্বভৌমত্বকে কেড়ে নিতে। এ প্রসঙ্গে আহমদ ছফা পশ্চিম বঙ্গের পত্রিকা ‘বাংলাবাজার’ কে একটি সাক্ষাৎকার দিয়েছিলেন এই লিংকে
স্বাধীনতা-স্বার্বভৌমত্বকে টিকিয়ে রাখতে, দিল্লীর গোলামীর বিরুদ্ধে দাঁড়াতে হলে আমাদের ইতিহাসকে পুনরুদ্ধার করতে হবে। আমাদের ধর্ম, ভাষা ও সংস্কৃতিকে ভালভাবে জানতে হবে। বাঙালি মুসলমানদের ইতিহাস ও সংস্কৃতি লুট হয়ে গেছে। কলকাতার বাবু বুদ্ধিজীবী ও সংস্কৃতিসেবী হানাদারদের মুখে লুট হওয়া আমাদের ইতিহাস, সংস্কৃতি ও ভাষাকে ফিরিয়ে এনে আমাদের জীবনে প্রতিষ্ঠা করতে হবে। নতুন কালের কারিগরদের সংস্কৃতির নতুন মিনার তৈরি করতে হবে। আর এজন্য প্রয়োজন একটি সবল মেরুদন্ডসম্পন্ন দেশপ্রেমিক নেতৃত্বের মাধ্যমে জনগনের মানস গঠন করা। মানস গঠন করতে হলে সংস্কৃতির বিভিন্ন মাধ্যমগুলোর যথাযথ ব্যবহার করতে হবে। সংস্কৃতির প্রত্যেকটি মাধ্যমে যথাযথ লোক তৈরি করে আমাদের ঐতিহ্যের, স্বাতন্ত্র্যের ও মৌলিকত্বের পরিচয় উপস্থাপন করতে হবে। নাটক দিয়ে নাটক, গান দিয়ে গান, চলচ্চিত্র দিয়ে চলচ্চিত্র, চিত্রকলা দিয়ে চিত্রকলার আগ্রাসনকে রুখে দিতে হবে। আর এই সমগ্র কর্মটির পিছনে থকবে মুসলিম আত্মপরিচয়কে সমুন্নত রাখবার প্রবল ইচ্ছা ও অঙ্গীকার। মনে রাখতে হবে ইতিহাসের নানা পর্বে নানারকম জুলুম ও অবিচারের বিরুদ্ধে ইসলাম পূর্ববাংলার মুসলমানদের পরিচয় জুগিয়েছে। আজকেও ইসলাম আমাদের পরিচয়ের প্রতীক।
বাংলা সাহিত্যে মুসলিম অবদান (১ম কিস্তি)
বাংলা সাহিত্যে মুসলিম অবদান (২য় কিস্তি)