যারা ইসলামী রাজনীতি করেন তাদের কেউ কেউ এ ভুল ধারণায় রয়েছেন, চোরের হাত কাটা এবং ব্যভিচারীকে দোররা মারার নাম শরিয়াতের শাসন।সত্যিকার অর্থে শরিয়াতের মাকসাদ হচ্ছে জনগণের কল্যাণ সাধন। শরিয়াহ মানে চোরের হাত কাটা নয়। শরিয়াহ শাসনের অর্থ হলো, এমন ব্যবস্থা নিশ্চিত করা যাতে কোন মানুষের মনে চুরি বা অবৈধ পথে সম্পদ অর্জনের ইচ্ছা বা প্রয়োজন সৃষ্টি না হয়। তা নিশ্চিত করার পথ সংক্ষেপে বলতে গেলে, দুটো এবং মাত্র দুটো। এক, মানুষের মনে নৈতিক শক্তি জাগ্রত করা এবং দুই, মানুষের মৌলিক প্রয়োজন পূরণের ব্যবস্থা করা। চোরের হাত কেটে এর কোনটাই অর্জন করা যায় না।
খলিফা হারুন-উর-রাশিদের সময়ের একটি ঘটনা ইতিহাসের পাতায় পাওয়া যায়। খলিফার কাছে একটি চিঠি এলো, শহরের বিচারক অসুস্থ থাকায় সেখানকার বিচারিক কাজ বন্ধ । খলিফা জবাব দেন, আগামী সপ্তাহের মধ্যে আপনাদের শহরে নতুন বিচারক আসবেন । নতুন বিচারক ঠিকই এক সপ্তাহের মধ্যে এসে হাজির হন । বিচার কাজ শুরু হলে নিরাপত্তা প্রহরীগণ প্রথমেই এক মহিলাকে আসামী হিসেবে হাজির করে। তার অপরাধ, তিনি শহরের এক দোকান থেকে কিছু রুটি আর মধু চুরি করতে গিয়ে ধরা পড়েন । বিচারকের জিজ্ঞাসার জবাবে মহিলা বলেন, গত এক সপ্তাহ থেকে আমি আমার দু এতিম নাতিসহ না খেয়ে ছিলাম। কান্না সহ্য না করতে পেরে চুরি করতে যাই। তার কথা শুনে বিচারক বললেন, এ বিচার আজ মুলতবী থাকবে। আগামীকাল শহরের সকল দায়িত্বশীল সরকারী কর্মকর্তা ও সুশীল সমাজের প্রতিনিধি যাতে বিচারালয়ে হাজির থাকেন সে ব্যবস্থা করা হোক। পরদিন কথামতো সবাই হাজির হলে তাদের সামনে বিচারক তাঁর রায় ঘোষণা করেন। তিনি রায়ে বলেন, মহিলার চুরির অপরাধ প্রমাণিত হয়েছে। তাই এর শাস্তি হিসেবে ৫০টি বেত্রাঘাত, ৫০০ দিরহাম জরিমানা করা হলো।জরিমানা অনাদায়ে এক বছর কারাদণ্ড ভোগ করতে হবে। সত্য বলার কারণে মহিলার হাত কাটা মাফ করা হলো।
এর পর বিচারক চাবুক আনার নির্দেশ দিয়ে নিজে এজলাস থেকে নেমে মহিলার পাশে গিয়ে দাঁড়ালেন । তখন বিচারক বললেন, যে দেশে ক্ষুধার্ত মহিলাকে পেটের দায়ে চুরি করতে হয় সে দেশে সবচেয়ে বড় অপরাধী সে দেশের শাসক। আমি এখানে খলিফার প্রতিনিধি। তাই ৫০টি চাবুকের ২০টি আমার প্রাপ্য । এটাই আমার রায়। এ কথা বলে বিচারক হাত বাড়িয়ে দিলেন। তাঁর দু হাতে ২০টি চাবুক মারা হলো। চাবুকের আঘাতে রক্ত পড়ছে দেখে কেউ কেউ এগিয়ে আসতে চাইলে বিচারক তাদের থামিয়ে দেন। এরপর বিচারক বললেন, যে শহরের প্রধান সরকারী কর্মচারীরা একজন গরীব মহিলার খাবার নিশ্চিত করতে পারেন না তারা সবাই অপরাধী।তাই অবশিষ্ট ৩০টি চাবুক সমানভাবে তাদের প্রাপ্য। কর্মচারীদের বেত্রাঘাত করার পর বিচারক নিজ পকেট থেকে বের করা রুমালের উপর ৫০টি দিরহাম রাখলেন । তারপর বললেন, যে সমাজ একজন মহিলাকে চোর বানায় এবং যেখানে এতিম শিশুরা অভুক্ত থাকে সে সমাজের সবাই অপরাধী । তাই উপস্থিত পাঁচ সরকারী কর্মকর্তার প্রত্যেককে ১০০ দিরহাম জরিমানা করা হলো। জরিমানা আদায়ের পর বিচারক নির্দেশ দেন, মোট ৫ শ’ দিরহামের ১ শ’ দিরহাম জরিমানা বাবদ রেখে বাকি ৪ শ’ দিরহাম থেকে ২০ দিরহাম চুরি হওয়া দোকানের মালিক পাবে। বাকি ৩৮০ দিরহাম অভিযুক্ত মহিলাকে দিয়ে বললেন, ‘এ অর্থ আপনার খরচপাতির জন্য। আগামী মাসে আপনি খলিফা হারুনুর রশিদের দরবারে আসবেন।’
একমাস পরে মহিলা খলিফার দরবারে গিয়ে হাজির হন। তার কাছে খলিফার আসনে বসা লোকটিকে চেনা চেনা মনে হলো । কাছাকাছি যাবার পর বুঝতে পারেন খলিফা-ই সেদিন বিচারক ছিলেন। খলিফা হারুন-উর-রশিদ আসন থেকে নেমে এসে বললেন মহিলাকে বললেন, ‘আপনাকে ও আপনার এতিম দু’নাতিকে উপোস রাখার জন্য সেদিন বিচারক হিসেবে ক্ষমা চেয়েছি। আজ আপনাকে দরবারে ডেকে এনেছি এ কথা বলার জন্যে যে, আমি খলিফা হিসেবে জনসাধারণের অধিকার রক্ষা করতে পারিনি। তাই অধম খলিফাকে আপনি দয়াকরে আমাকে মাফ করে দিন।’
ইসলামের মূলকথা হলো ব্যক্তিগতভাবে আল্লাহর সাথে ঘনিষ্ট সম্পর্ক তৈরি এবং সামাজিক ভাবে জুলুম-শোষণ এবং বৈষম্যমুক্ত সমাজ কায়েম করা। ক্ষমতা দখল নয়, জনগণের কল্যাণ সাধন এবং ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা থাকবে এর লক্ষ্য। ইমাম আবু হানিফা থেকে শায়খ আহমদ সরহিন্দ পর্যন্ত যুগে যুগে আমাদের সলফে-সালেহিন এভাবেই কাজ করেছেন।তারা ক্ষমতা দখলের রাজনীতি করেননি। তোষামোদ, মন্ত্রীত্ব বা উপঢৌকনের রাজনীতি করেননি। বাংলাদেশের ইসলামী ঘরাণার অনেকে অতীতে মন্ত্রীত্ব এবং ক্ষমতার রাজনীতি করেছেন। কিন্তু তা কারো জন্যে কল্যাণবহ হয়নি। বরং কারো কারো সে কাজের জন্যে অনেক ব্যক্তি, দল এবং পুরো দেশকে খেসারত দিতে হচ্ছে। সত্যি কথা হচ্ছে, মক্কার তের বছর উপেক্ষা করে কেউ ইয়াসরিবে যেতে চাইলে তিনি কখনো মদিনায় যেতে পারবেন না।
ক্ষমতার রাজনীতির জন্যে যাদের ঘুম হারাম তাদের জন্যে এখানে মহানবী (স)-এর একটি বক্তব্য উল্লেখ করতে চাই। এ হাদিসটি তিরমিজি শরিফে বর্ণিত হয়েছে এবং কা’আব বিন উজরা রেওয়ায়েত করেছেন। মহানবী (স) বলেন, ‘হে কা’আব, আমার পরে এমন সব শাসক আসবে, তাদের হাত থেকে আমি তোমাকে আল্লাহর আশ্রয়ে প্রদান করছি। যারা সে অত্যাচারী শাসকের কাছে যাবে, তাদের মিথ্যাচারকে সমর্থন করবে এবং তাদের অত্যাচারে সহযোগী হবে তাদের সাথে না আমার কোন সম্পর্ক আছে, না তারা আমার সাথে কোন সম্পর্ক রাখে।হাউযে কাওসারে তারা আমার সাথে সাক্ষাত করতে পারবে না। যারা এ সব জালিম শাসকের কাছে যাবে না, আর যদিও যায় তবে তাদের মিথ্যাচারকে সমর্থন করবে না, তাদের জুলুমে সহযোগী হবে না, তারা আমার লোক এবং আমি তাদের লোক। আর হাউযে কাওসারে তারা আমার সাথে মিলিত হবে।’