একটি দেশ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থা পরিচালনার ক্ষেত্রে বর্তমান ধারার যে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার যাত্রা তা আধুনিক ধারার ইতিহাস পাঠে খুব বেশি পুরানো নয়। ১৬ তম মার্কিন প্রেসিডেন্ট আব্রাহাম লিংকন (১৮০৯- ১৮৬৫) এর ১৮৬৩ সালে পেনসিলভানিয়ার গেটিসবার্গে প্রদত্ত ‘গেটিসবার্গ ভাষণ’ এর মাধ্যমেই শুরু হয় গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার নতুন পদযাত্রা। যদিও পশ্চিমা রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দার্শনিক আলোচনায় এই ব্যবস্থার ভিত্তি দাঁড় করানো হয়ে খ্রিষ্টপূর্ব পঞ্চম শতাব্দীর (৫০৮/৭ খ্রিষ্ট পূর্বাব্দ) পুরানো গ্রীক সমাজ ব্যবস্থায় । তবে মানুষের এই “গণতন্ত্র মনন” এবং এর বাস্তবায়ন ব্যবস্থাপনার উৎপত্তি আরো সুপ্রাচীন। মানব-সৃষ্টির ভেতরই এই সত্তা বিরাজমান। কারণ স্রষ্টা যখন মানুষকে সৃষ্টি করেন তখনই তাতে রেখে দেন নানান সীমাবদ্ধতা। আর মানব সীমাবদ্ধতার এক আবশ্যিক বহিপ্রকাশ হচ্ছে এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা। কারণ মানুষ যখন একক ক্ষমতা কিংবা মেধা বলে কোন কাজ করতে অসমর্থ হয় তখন তাকে অন্যের সাথে পরামর্শ করতে হয়, অন্যের নিকট সাহায্য চাইতে হয়- এখানেই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার অন্তর্নিহিত ভিত্তি । এর নমুনা মিলে পৃথিবীর প্রথম সৃষ্ট নর-নারী আদম ও হাওয়ার কুরআনী বর্ণনায়, যখন দেখা যায় তাদেরকে একে অন্যের সাথে পরামর্শ করতে।
মানব সৃষ্টির ভেতর এই যে বিরাজমান আবশিক ‘সত্ত্বা’ তা লক্ষকোটি বছরের পথ পরিক্রমায় আমাদের সামনে আজকের বর্তমান রুপে প্রতিষ্ঠিত রাজনৈতিক এক মতবাদ হিসাবে উপস্থিত। রাজনৈতিক ব্যবস্থায় নানান বিতর্ক ও শর্ত থাকা সত্ত্বেও গণতন্ত্রের যে রুপটি আজ উপস্থিত তা বিশ্বব্যাপি ‘প্রভাবশালী মত’ হিসাবে প্রতিষ্ঠিত এবং বিশ্বব্যাপি জাতি ধর্ম নির্বিশেষে অধিকাংশ দেশেই এই ব্যবস্থা আজ প্রচলিত।
আপাত ব্যবস্থা হিসাবে গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার যে সৌন্দর্য তা হচ্ছে- এখানে সরকার পরিচালনায় ছায়া মন্ত্রীসভা হিসাবে বিরোধী দলের মতামত প্রকাশের সূযোগ এবং দেশ পরিচালনায় বিরোধী দলের অংশগ্রহণ। এখানে শুধু সরকারি দলই অংশগ্রহণ করেনা বরং সাধারণ জনগণের ভেতর থেকে যে কোন ব্যক্তি, বা সরকার পরিচালনার বাইরে অবস্থানকারি যে কোন দল তার মতামত প্রকাশের সূযোগ পেয়ে থাকে। সমাজতান্ত্রিক বা স্বৈরাচারী সরকারি ব্যবস্থার পাশাপাশি রেখে বিবেচনা করলে এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার কল্যাণ অনুধাবন করা আমাদের জন্য সহজতর হয়।
যে কোন দেশের গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা যত বেশি উন্নত সেই দেশের সরকার পরিচালনা ব্যবস্থায় মানুষের মতামত প্রকাশের সূযোগ তত বেশি। মানুষের মতামত প্রকাশের স্বাধীনতা যেখানে যত বেশি, সেখানে আইনের শাসন তত বেশি সুদৃঢ়। আইনের শাসন যেখানে যত বেশি, সেখানকার সমাজব্যবস্থায় মানুষের অধিকার তত বেশি সমুন্নত। যেখানে সাধারণ মানুষের আইনী অধিকার যত বেশি সুরক্ষিত সেখানকার আর্থ-সামাজিক ব্যবস্থায় মানুষের অংশগ্রহণ তত বেশি। আর সমাজ বা রাষ্ট্র ব্যবস্থায় জনমানুষের অংশগ্রহণই নিশ্চিত করে সেই সমাজব্যবস্থার সামগ্রিক উন্নয়ন বা অগ্রগতি। আর এ কারণেই গণতন্ত্রকে আজ সামাজিক বা রাষ্ট্রিক উন্নয়নের সমার্থক হিসাবে সমীকৃত করা হয়ে থাকে। তবে এই উন্নয়নের সমীকরণ শর্তহীন নয়। উন্নয়ন অগ্রগতির এই সমীকরণ শর্তসাপেক্ষ। আধুনিক বিশ্বে (তথাকথিত) উন্নত হিসাবে যে দেশগুলো পরিচিত তাদের উন্নয়নের মূল কারণ দেশের অভ্যন্তরীন আইনী কাঠামোয় এই গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার উপস্থিতি। যদিও মাত্রাতিরিক্ত পুঁজিবাদি দর্শন ধীরে ধীরে এই সব দেশের সামগ্রিক উন্নয়নের পরিবর্তে ব্যক্তি বা গোষ্ঠীবর্গের উন্নয়নের হাতিয়ারে পরিণত হচ্ছে।
তথাকথিত আধুনিক ও অর্থনৈতিকভাবে উন্নত দেশগুলোর বিপরীতে তৃতীয় বিশ্বের অন্তর্ভুত দেশগুলোতে গণতন্ত্রের অবস্থা কিন্তু তথৈবচ । গণতন্ত্রের শিকড় আজও এই সব দেশে শিকড় গাড়েনি। এই সব দেশে গণতন্ত্রের যে সৌন্দর্য তা আজও বিকশিত হয়নি। বিরোধী দলের মতামত প্রকাশ কিংবা ব্যক্তি স্বাধীনতার যে অধিকার তা আজও প্রচ্ছন্ন। বিরোধী দল এই সব দেশে ছায়া সরকারের রুপ পরিগ্রহ করেনি, যেমনটি দেখা যায় ইউরোপ, আমেরিকা এমনকি প্রতিবেশী ভারতের মত দেশে। এমনকি পররাষ্ট্র নীতির ক্ষেত্রেও এই সব দেশে বিরোধী দল কিংবা সাধারণ জনগণের মতামত উপেক্ষিত। এই সব দেশে যারা সরকার গঠন করে তারাই হয়ে পড়ে দেশের দন্ডমুন্ডের কর্তাসত্ত্বা।
বাংলাদেশ বিশ্ব মানচিত্রে তৃতীয় বিশ্বের একটি দেশ। জনসংখ্যার দিক দিয়ে অষ্টম (সিআইএ ফাক্টবুক) এবং বিশ্বের সবচেয়ে বেশি ঘনত্ববিশিষ্ট (বড় দেশগুলোর ভেতর) এই দেশের জনসংখ্যা প্রায় ১৬ কোটি (বিবিএস)। বাংলদেশ প্রায় দুইশ বছর ব্রিটিশদের অধীনে শাসিত হয়েছে। কিন্তু এই দুইশ বছরেও এদেশের রাজনৈতিক নেতা-কর্মীরা ব্রিটিশদের উন্নয়নের মূল রহস্য ধাতস্থ করতে পারেন নি। ১৯৭১ সালে স্বাধীনতা লাভের পর প্রায় চার দশকের বেশি সময় অতিক্রম করছে এই দেশ। বাংলাদেশের স্বাধীনতার যে ঘোষণাপত্র তার অন্যতম মূলনীতিও ছিল গণতন্ত্র। কিন্তু বিগত চারদশকের বেশি সময়েও এদেশের রাজনৈতিক কাঠামোয় গণতন্ত্রের ভিত্তি মজবুত হয়নি। এদেশের রাজনৈতিক দলগুলোর ভেতর কিংবা বাইরে রাজনৈতিক শিষ্টাচার এখনো তার শিকড় গাড়েনি গভীরভাবে।
গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার যে সৌন্দর্য তা যেমন গরহাজির এদেশের জাতীয় রাজনীতিতে, তেমনি এর সুফল হতে বঞ্চিত এদেশের জনমানুষ। গণতান্ত্রিক ব্যবস্থার সৌন্দর্য হচ্ছে রাজনীতি, সমাজনীতি, অর্থনীতিসহ অন্য সকল কাঠামোয় ব্যক্তি কিংবা রাজনীতিতে বিরাাজমান সকল দলের অংশগ্রহণ। যিনি যেই মত বা দলের সমর্থক কিংবা নেতা-কর্মী হোন না কেন, জাতীয় স্বার্থের ক্ষেত্রে তারা হবেন এক ও অভিন্ন। আপন আপন জায়গা ও অবস্থান থেকে তারা তাদের সুচিন্তিত মতামত দিয়ে সাহায্য করবেন সরকার পরিচালনাকারি দলকে। এক্ষেত্রে সরকার সরকারের ভেতর ও বাইরে অবস্থারকারি সকলের ভূমিকাই গুরুত্বপূর্ণ। সরকারের বাইরে যারা অবস্থান করবেন তারা পালন করবেন ছায়া সরকারের (স্যাডো ক্যাবিনেট) এর ভূমিকা। তাদেরকে যে বিরোধী দল হিসাবে আখ্যায়িত করা হয় তা যেন আক্ষরিক অর্থেই বিরোধীতাপূর্ণ না হয়ে উঠে। কারণ, কারণে কিংবা অকারণে সরকারের বাইরে অবস্থানরত দল যদি বিরোধীতা করা শুরু করে তাহলে তা হয়ে উঠে গণতন্ত্রের জন্য হুমকীস্বরুপ। গণতন্ত্রের যে সৌন্দর্য তা ব্যাহত হয়। মানুষ, সমাজ, রাষ্ট্র বঞ্চিত হয় সকলের যোগ্যতামূলক অংশগ্রহণ থেকে। আর এতে মূলত ক্ষতিগ্রস্থ হয় দেশের আপামর জনসাধারণ। কারণ যখন দেশের রাজনীতিতে সকল দল, বা জনমত প্রতিফলনের অবারিত সূযোগ থাকেনা, তখনি দেশে আইনের শাসন ভুলুন্ঠিত হয়। স্বেচ্ছাচার পেয়ে বসে রাষ্ট্রীয় ব্যবস্থাপনায়। দূর্নীতি আশ্রয় গাড়ে সকল ক্ষেত্রে। সকল কাজে শ্লথ গতি পরিলক্ষিত হয়। আমলাদের লালফিতার দৌরাত্ম্য দেখা যায় সকল রাষ্ট্রীয় নিয়ম নীতিমালায়। ফলে দেশের সামগ্রিক উন্নয়ন হয় বাধাগ্রস্থ। আর এর চাপ গিয়ে পড়ে দেশের দরিদ্র জনগোষ্ঠীর উপর।
বাংলদেশসহ তৃতীয় বিশ্বের দেশগুলোতে উন্নয়নের পথে দূর্নীতি আজ মস্ত বড় এক বাধা। আর এই দূর্নীতির অন্যতম ভোক্তা হচ্ছেন আমলা, রাজনীতিবিদ ও নীতিহীন ব্যবসায়িক গোষ্ঠী। এই ত্রিবিধ শক্তির সমন্বয়েই সাধিত হয়ে থাকে দূর্নীতির যত কাজ। দেশের জাতীয় রাজনীতিতে যখন গণতান্ত্রিক ব্যবস্থা শক্তিশালী হয়, আইনের শাসন উচ্চকিত হয়, তখন দূর্নীতিবাজ আমলা ও নীতিহীন ব্যবসায়িক গোষ্ঠীর আষ্ফালন হ্রাস পায়। ফলে সরকার পরিচালনায় থাকা রাজনীতিবিদদের দুর্নীতির সুযোগ কমে আসে। কাজেই নিজেদের স্বার্থেই এই স্বার্থান্ধ আমলা ও ব্যবসায়িক গোষ্ঠি জাতীয় রাজনীতিতে এই বিভেদের জাল বিছিয়ে রাখেন। দেশে প্রকৃত গণতন্ত্রের চর্চা না হোক তার পথ প্রশস্ত করার অপচেষ্টায় লিপ্ত থাকেন।
বর্তমান বিশ্ব আজ গ্লোবালাইজড। তথ্য-প্রযুক্তির কল্যাণে পুরো দুনিয়া আজ একটি মাত্র ওয়েবের জালে বন্দী। তথ্য প্রযুক্তির কারণেই সকল দেশের স্বার্থ আজ একে অন্যের সাথে মিলে মিশে একাকার। ফলে আগের দিনের মত কোন দেশই আজ স্বাধীন ভাবে থাকতে পারেনা, পারেনা স্বাধীন ভাবে নিজ নিজ দেশের অভ্যন্তরীন কিংবা পররাষ্ট্র নীতি নির্ধারণ করতে। কারণ কোন না কোন ভাবেই সকল দেশই একে অন্যের উপর নির্ভরশীল। আমদানি কিংবা রপ্তানি বাণিজ্য যে কারণেই হোক না কেন, এক দেশ আরেক দেশের উপর নির্ভরশীল। পারস্পরিক নির্ভরশীলতা যেমন কল্যাণকর তেমনি অকল্যাণকরও। কারণ কল্যাণকর কিংবা অকল্যাণকর হওয়া নির্ভর করে পারস্পরিক ভাবে মেনে চলা কিছু মূল্যবোধ ও মূলনীতির উপর। আগের দিনে সকল দেশই সামগ্রিক মানবতাবাদকে প্রাধান্য দিয়ে ফরেন পলিসি নির্ধারণ করত। এখন সেখানে আশ্রয় নিয়েছে পুঁজিবাদ। যে কোন ভাবে নিজের লাভালাভকেই প্রাধান্য দেয়া হয় একমাত্র চাবিকাঠি হিসাবে। ফলে মানবতাবাদ আজ উপেক্ষিত। অর্থনৈতিক স্বার্থই আজ একমাত্র মানদন্ড।
বর্তমান এককেন্দ্রিক বিশ্বব্যবস্থায় সকল দেশের স্বাধীনতা আজ অর্থনৈতিক শক্তির সাথে সমানুপাতিক। কারণ দেশের সামরিক, রাজনৈতিক, বা আদর্শিক যে কোন উন্নয়নের জন্য প্রয়োজন শক্ত আর্থনীতিক ভিত্তি। আর্থনীতিক ভিত্তি মজবুত হলে ভবিষ্যতের যে কোন পরিকল্পনা বাস্তবায়ন করা সহজতর হয়। আর এই আর্থনীতিক ভিত্তি মজবুত হয় যখন দেশের সামগ্রিক ব্যবস্থায় গণতন্ত্রের অবস্থান শক্তিশালী হয়। গণতন্ত্র শক্তিশালী না হলে দেশের অর্থনৈতিক অবস্থান মজবুত হবার আশা তাই বাতুলতামাত্র।
যে কোন দেশের রাজনৈতিক ব্যবস্থাপনা তাই অতি গুরুত্বপূর্ণ। রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ও শক্তিশালী গণতন্ত্র সে দেশের স্থিতিশীল উন্নয়নের পূর্বশর্ত। স্থিতিশীল উন্নয়নই সাধারণ মানুষের জীবন যাত্রার উন্নয়নের একমাত্র উপায়। আর সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রার এই উন্নয়ন প্রভাব রাখে জনগণের শিক্ষা-দীক্ষা, সংস্কৃতি, মানবিক ও আদর্শিক উন্নয়নের ধারায়। সংশ্লিষ্ট জনগণের আদর্শিক ও মানবিক উন্নয়ন যত টেকসই হবে ততই মজবুত হবে সেই সমাজের সামাজিক গঠন। শক্তিশালী হবে সামাজিক বুনন ও মেলবন্ধন। আর এর সাথে সমানুপাতিক হবে সেই দেশের মানুষের হিউম্যন ডেভেলপমেন্ট ইন্ডেক্স (Human Development Index-HDI) বা গ্রস হ্যাপিনেস ইন্ডেক্স (Gross Happiness Index- HDI) যা সমানুপাতিক হারে সংশ্লিষ্ট দেশের জনগণকে উদ্দীপ্ত করবে দেশের স্বাধীনতা রক্ষায় শক্তিশালী রক্ষাকবচের ভূমিকা পালন করতে।
সকল দল ও মতের সমন্বয়ে গড়ে উঠা শক্তিশালী গণতন্ত্রই এদেশের টেকসই উন্নয়ন তথা স্বাধীনতা-সার্বভৌমত্বের একমাত্র গ্যারাণ্টি। দেশের দরিদ্র জনগণের টেকসই উন্নয়ন এবং কষ্টার্জিত স্বাধীনতা রক্ষার নিমিত্ত সকল রাজনৈতিক দলের সম্মিলিত অংশগ্রহণের মাধ্যমে বর্তমান অস্থিতিশীল গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করা জরুরী। সকল দলের সম্মিলনে তাই গণতন্ত্রকে করতে হবে কার্যবহ। কার্যবহ ও কার্যকর গণতন্ত্র প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই স্থিতিশীল হোক দারিদ্র পীড়িত বাংলদেশের টেকসই উন্নয়ন যা এদেশের স্বাধীনতা ও সার্বভৌমত্বের একমাত্র ভবিষ্যত।
………………………………