লিখেছেনঃ Shafquat Rabbee Anik
দুটো আন্তর্জাতিক মানের মিথ্যে কথা অনেকের ফেইসবুক পোস্টে দেখতে পারছি। বারবার, অনেকে মিলে একই মিথ্যে কথা এক সাথে বলে মিথ্যেকে সত্যি বানিয়ে ফেলার বেশকিছু কারিগর আছেন আমাদের দেশের একটি বিশেষ গোষ্টির মাঝে। তাদের এই টেকনিকের সাফল্য আসলেই অনেক।
এই মিথ্যে গুলোর একটাতে বলা হচ্ছে যে হিটলারের নির্দেশে সঙ্ঘটিত ইহুদী গনহত্যার সংখ্যা নিয়ে নাকি প্রশ্ন করা যায় না বা করা হয় না।
দ্বিতীয় মিথ্যে কথা হলো কোন গনহত্যার নাকি হতাহতের তালিকা পাওয়া যায় না বা কেউ জিজ্ঞেস করে না, বা কেউ কোন তালিকা বানায় না।
শুরুতে আসি হলোকাস্ট বা হিটলারের হাতে গনহত্যাকৃত ইহুদীদের মৃতের সংখ্যা নিয়ে একাডেমিক রিভিশনের ইতিহাসে।
প্রায় ৪৫ বছর ধরে বিশ্বের গুরুত্বপূর্ন অনেক দেশের সরকারী ও বেসরকারী ডকুমেন্টে উল্লেখ করা হতো হলোকাস্টের শুধু অসউইজ ক্যাম্পেই মারা হয়েছিল সাড়ে ৪ মিলিয়ন (৪৫ লক্ষ) ইহুদীকে। এই সঙ্খ্যাটি এসেছিল কমিউনিস্ট পোল্যান্ডের সরকারী কর্মকর্তাদের সোর্স থেকে। পোল্যান্ড ছিল সোভিয়েত ইউনিয়নের অনুগত। আর সোভিয়েত ইউনিয়নের অনেক পুরনো শত্রু ছিল জার্মানী। একারনে সোভিয়েত সরকারের অনুগত পোলিশ সরকার অসউইজ ক্যাম্পের ডেথ টল প্রায় ৪৫ বছর ধরে ৪৫ লক্ষ বলে আসছিল। সোভিয়েত ইউনিয়নের পতনের পড়ে পোলিশ সরকারী হিসেবে ব্যাপক পরিবর্তন আসে। তারা জনসমক্ষে স্বীকার করতে শুরু করে যে নম্বরটা আসলে ৪৫ লাখ নয়, এটা ১০ লাখ। একাডেমিক স্টাডিতে দেখা যায় পোলিশ সরকার অন্তত প্রায় ১০ বছর ধরে জেনে শুনে মিথ্যা কথা বলেছে।
যে কেউ গুগুলে গিয়ে “auschwitz revision” এই শব্দদুটো দিয়ে সার্চ করলে পেয়ে যাবেন কিভাবে ১৯৯০ এর দশকে এসে, ঘটনার ৪৫ বছর পড়ে, ৪৫ লাখ থেকে ১০ লাখে নেমে আসে অসউইজ ক্যাম্পের হলোকাস্টে নিহতের সংখ্যা। বিশ্ব বিখ্যাত শিকাগো ট্রিবিউন এবং ইন্টারন্যাশনাল হিস্টরিকাল রিভিউ এর দুটো আর্টিকেলের লিঙ্ক নিচে দিলাম। উতসাহী কেউ পড়ে নিতে পারেন এই গনহত্যার নিহতের সংখ্যা ৪ দশকে ৪ গুন কমে যাওয়ার ইতিহাস। এই সংখ্যা আরো কমানো কিংবা বাড়ানোর সম্ভাবনা নিয়ে এখনো কাজ করে যাচ্ছেন রিস্যার্চাররা। কোন আইন করে এই রিস্যার্চ বন্ধ করা হয়নি।
http://articles.chicagotribune.com/…/9202100662_1_death-wal…
http://www.ihr.org/jhr/v21/v21n3p24_weber.html
এবার আসি দ্বিতীয় মিথ্যাটি প্রশংগে। বলা হচ্ছে যে কোন গনহত্যার নাকি তালিকা হয় না, লিস্ট হয়না, কেউ চায় না, ইত্যাদি।
নিচের লিঙ্কে গেলে প্রায় ৪ মিলিয়ন জিউ এর নাম পাবেন যারা গনহত্যার শিকার হয়েছিলেন। এটা হলোকাস্টের সবচাইতে বড় নেইম ডাটাবেইজ।
http://db.yadvashem.org/names/search.html?language=en
নিচের লিঙ্কে গেলে আমেরিকার দুই মহা যুদ্ধে হতাহতের লিস্ট পাবেন। লিস্টটি আমেরিকার স্টেট বাই স্টেট ইমেজ আকারে দেয়া আছে।
http://www.archives.gov/research/military/…/navy-casualties/
http://www.archives.gov/research/military/…/army-casualties/
নিচের লিঙ্কটি কমনয়েলথ গ্রেইভ কমিশনের। এখানে প্রথম ও দ্বিতীয় বিশ্ব যুদ্ধে নিহত ১৭ লক্ষ কমনওয়েলথ মেম্বার দেশের মানুষের নামের লিস্ট আছে। এই লিস্ট বানাতে ১৫৪টি দেশের ২৩ হাজার কবরস্থান ও গনকবর নিয়ে কাজ করতে হয়েছে কমনয়েলথ গ্রেইভ কমিশনের। কবরের সংখ্যা এবং দেশের সংখ্যা একটু খেয়াল করুন। লিঙ্কঃ
উদাহরন হিসেবে নিচের লিঙ্কে যেতে পারেন। এখানে দুই মহাযুদ্ধে নিহত ভারতীয়দের নাম আছে।
http://www.cwgc.org/find-war-dead.aspx?cpage=1
প্রাইভেট কোম্পানি আন্সেস্ট্রি ডট কমের নিচের পেইজে গিয়ে যে কেউ বিগত ১০০ বছরে মুলত ইংরেজী ভাষাভাষী দেশ গুলোর যে কোন নিহতের নাম দিয়ে সার্চ দিতে পারেন।
http://search.ancestry.com/search/category.aspx?cat=127
নিচের লিঙ্কে গেলে ফ্যাসিজমের গুরুত্বপূর্ন ভিক্টিমদের একটা তালিকা পাবেন। এরকম একটা তালিকা আমাদের বুদ্ধিজীবিদের নিয়ে কিংবা সমাজের গন্যমান্য শহীদের দিয়ে হওয়া উচিত।
https://en.wikipedia.org/wiki/List_of_victims_of_Nazism
আমাদের মুক্তিযুদ্ধের ৪ বছর পরে ১৯৭৫-১৯৭৯ সালে এশিয়ার খুব কাছাকাছি আর একটি এলাকায় গনহত্যা হয়েছিল। সেটা হলো কম্বডিয়ার খেমারুজ বাহিনীর হাতে সঙ্ঘটিত গনহত্যা যার ভিক্টিমের সংখ্যা ১৭ লাখ (এক দশমিক সাত মিলিয়ন)। এই গনহত্যাটি নানা কারনে বাংলাদেশীদের খুব গুরুত্ত্বের সাথে স্টাডি করা উচিত। আমেরিকান ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্বডিয়া জেনসাইড প্রোগ্রামের ওয়েবসাইটে গেলে এই গনহত্যার অনেক গুরুত্বপূর্ন ডকুমেন্ট পাওয়া যায়।
ইয়েল বিশ্ববিদ্যালয়ের কাম্বোডীয়া জিওগ্রাফিক ডাটাবেইজে ১৭ লক্ষ মানুষের হতাহতের সাক্ষ্য হিসেবে পলপটের লোকদের দ্বারা পরিচালিত ১৫৮টি জেলখানা এবং ৩০৯টি গণকবরের কথা তথ্যা প্রমান হিসেবে উল্লেখ করা হয়। ইয়েলের গণকবরের ডেফিনেশন হচ্ছে ৬ জনের বেশী লাশ পাওয়া যেতে হবে। কম্বডিয়ার এই ৩০৯টি গনকবর এলাকায় ২৫৮টি গনকবরে ৬ এর বেশি লাশ, ১২৫টি গনকবরে ১ হাজারের বেশি লাশ, ২৭টি গনকবরে ১০ হাজারের বেশি লাশ, এবং ৭টি গণকবরে ৩০ থেকে ৭০ হাজার মানুষের লাশ পাওয়া যাওয়ার এভিডেন্স রয়েছে। জেনে রাখা প্রয়োজন, জেনসাইড স্টাডিজে সব চাইতে গুরুত্বপূর্ন এভিডেন্স হলো গণকবর। হাজার বছর পরেও মানুষের কঙ্কাল পাওয়া যায়।
কঙ্কাল ইজ একচুয়েলি ভেরি ডিফিকাল্ট টু হাইড।
উপরের তথ্য উপাত্ত থেকে বুঝা যাওয়া উচিত হলোকাস্টের মৃতের সংখ্যা কমানো বাড়ানো নিয়ে এখনও রিস্যার্চ চলছে। আর গনহত্যার সিভিলিয়ান ও সামরিক উভয় প্রকার নিহতের একাধিক ডাটাবেইজ আছে। আমাদের কেন নেই? ডাটাবেইজ বানাতে বললে এতো রাগের কারন কি?
এখন কেউ প্রশ্ন করতে পারেন, ভাই এতো তথ্য উপাত্ত কেন দিচ্ছেন? বাংগালীর আবেগের ৩০ লক্ষকে আঘাত করার জন্যে নাতো?আমার উত্তর খুব সোজা। কারো আবেগে আঘাত করার কোন ইচ্ছা আমার নেই। তবে এই আবেগ নিয়ে কিছু কথা বলা প্রয়োজন।
পাঠক বুঝতেই পারছেন উপরে দেয়া তথ্যগুলো সিম্পল গুগুল সার্চ করেই পাওয়া যায়। তারপরেও আমাদের দেশের একটা বিশেষ গোষ্টির লোকজন এগুলো নিয়ে মিথ্যে কথা বলেন। কেন বলেন সেটা নিয়ে ভাবার প্রয়োজন আছে।
আর আবেগ প্রসঙ্গে বলতে গেলে বলতে হয় আমাদের আবেগ কিন্তু খালি আবেগের জায়গায় থাকে না। এই আবেগ থেকে ঘৃণা, এবং ঘৃণা থেকে ফ্যাসিজমের জন্ম হয়। আরো অনেক কারনের পাশাপাশি, এই “আবেগ-ঘৃনা-ফ্যাসিজম” চক্রের কারনেই বাঙ্গালির আবেগকে র্যাশনাল ও তথ্য উপাত্তের মধ্যে রাখা জরুরী।
ইউ ক্যান হ্যাভ ইউওর ওউন আবেগ, বাট নট ইউর ওউন ফ্যাক্টস।