লিখেছেনঃ হারুন উর রশীদ স্বপন
ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনীর হাতে বাংলাদেশের নাগরিক হত্যা কমার কোনো লক্ষণ নেই৷ গত তিন বছরের পরিসংখ্যান বলছে, সীমান্ত হত্যা বাড়ছে৷ অথচ ভারতের শীর্ষ পর্যায় থেকে এই হত্যা শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনার প্রতিশ্রুতি দেয়া হয়েছে৷
গরু চোরাচালানের কারণে সীমান্ত হত্যা হচ্ছে – এই তত্ত্বটিও আর টিকেছে না৷ কারণ ভারত থেকে বাংলাদেশে গরু চোরাচালান প্রায় বন্ধ হয়ে গেলেও, সীমান্ত হত্যা বন্ধ হয়নি৷
‘কমেছে গরু পাচার, বেড়েছে সীমান্ত হত্যা’ – গত ১ ডিসেম্বর খবরটি দেয় ইন্ডিয়ান এক্সপ্রেস৷ খবরে বলা হয়, ‘গত বছরের এপ্রিল মাসে ভারতের স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী রাজনাথ সিং বাংলাদেশে ভারত থেকে গরু পাচার বন্ধের নির্দেশ দেয়ার পর, সাত মাসে গরু চোরাচালান শতকরা ৭০ ভাগ কমে গেছে৷ কিন্তু বিপরীতে সীমান্ত হত্যা না কমে বরং বেড়েছে৷ রাজনাথ সিং-এর ঘোষণার পর ২০১৫ সালের অক্টোবর পর্যন্ত ভারতীয় সীমান্ত রক্ষী বাহিনী (বিএসএফ)-এর গুলিতে ২৪ জন গরু পাচারকারী নিহত হয়েছেন৷ আগের বছর, ২০১৪ সালে সীমান্তে হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছিলেন ১০ বাংলাদেশি৷’
২০১১ সালে বিএসএফ ও বর্ডার গার্ড বাংলাদেশ (বিজিবি) পাচারকারী ও অবৈধপথে সীমান্ত পার হওয়া মানুষদের ক্ষেত্রে প্রাণঘাতি অস্ত্র ব্যবহার না করার চুক্তি স্বাক্ষর করে৷ এ চুক্তির পরবর্তী কয়েকবছর সীমান্ত হত্যা কমে আসলেও, এখন আবার তা বাড়ছে৷ গত তিন বছরের পরিসংখ্যানও বলছে সে’কথাই৷
বাংলাদেশের মানবাধিকার সংগঠন আইন ও সালিশ কেন্দ্রের (আসক) হিসেবে, গত তিন বছরে বিএসএফ-এর হাতে সীমান্তে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা বেড়েছে৷ এই হত্যাকাণ্ডগুলি ঘটছে গোলাগুলি ও নির্যাতনের কারণে৷ তাদের হিসাব অনুযায়ী, ২০১৩ সালে মোট ২৭ জন বাংলাদেশিকে হত্যা করেছে বিএসএফ সদস্যরা৷ এদের মধ্যে ১২ জনকে গুলি করে এবং ১৪ জনকে নির্যাতন চালিয়ে হত্যা করা হয়৷ বাকি একজনকে কীভাবে হত্যা করা হয়েছিল, তা জানা যায়নি৷
এরপর ২০১৪ সালে হত্যা করা হয়েছে ৩৩ জন বাংলাদেশিকে৷ এরমধ্যে গুলি ও নির্যাতনে সমান সংখ্যক বাংলাদেশিকে হত্যা করা হয়৷ গত বছরে হত্যা করা হয়েছে ৪২ জনকে, আহত হয়েছেন ৬৮ জন৷ এছাড়া বিএসএফ ধরে নিয়ে গেছে ৫৯ জনকে৷ গত তিন বছরে সীমান্তে বাংলাদেশি হত্যায় ২০১৫ সাল শীর্ষে অবস্থান করছে৷ চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে বিএসএফ হত্যা করেছে তিনজন বাংলাদেশিকে৷
তবে আরো একটি চিত্র আছে৷ আর তা হলো, বাংলাদেশ-ভারত সীমেন্ত বিএসএফ শুধু বাংলাদেশিদেরই হত্যা করছে না, তাদের হাতে সীমান্ত এলাকায় ভারতের বাঙালিরাও নিহত হচ্ছেন৷ ভারতের মানবাধিকার সংগঠন বাংলার মানবাধিকার সুরক্ষা মঞ্চ (মাসুম)-এর প্রধান কিরীটি রায় জানান, ‘‘ভারতীয় নগরিকরাও বিএসএফ-এর হাতে নিহত হচ্ছেন৷ গত এক বছরে বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমবঙ্গ সীমান্তে যে ২৫ জন ভারতীয় নাগরিক নিহত হয়েছেন, তারা বাঙালি৷ পুরো সীমান্তের হিসাব করলে এই সংখ্যা আরো অনেক বেশি হবে৷”
এরসঙ্গে আরেকটি তুলনামূলক চিত্র বেশ অবাক হওয়ার মতো৷ তা হলো – তিন বছরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ-এর হাতে মোট ১০২ জন বাংলাদেশি নাগরিক নিহত হলেও, একই সময়ে পাকিস্তান-ভারত সীমান্তে বিএসএফ-এর হাতে ৪৬ জন পাকিস্তানি নাগরিক নিহত হয়৷ নিহত পাকিস্তানি নগারিকদের বড় একটি অংশ সামরিক এবং আধা সামরিক বাহিনীর সদস্য৷ তবে বাংলাদেশের নিহত নাগরিকরা সবাই নিরস্ত্র সাধারণ মানুষ৷
সীমান্তে বাংলাদেশি ফেলানী হত্যার সরকারি কৌঁসুলি আব্রাহাম লিংকন ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এই পরিসংখ্যানই বলে দিচ্ছে যে, সীমান্তে বিএসএফ বাংলাদেশি নাগরিকদের সঙ্গে শত্রু রাষ্ট্রের চেয়েও খারাপ আচরণ করছে৷”
আসক-এর পরিচালক নূর খান ডয়চে ভেলেকে বলেন, ‘‘এতদিন গরু চোরাচালানকে সীমান্ত হত্যার কারণ হিসেবে বলা হতো৷ কিন্তু এখন তো গরু চোরাচালান বলতে গেলে শূন্যের কোঠায়৷ তারপরও সীমান্তে বিএসএফ-এর হাতে বাংলাদেশি নাগরিক হত্যা বাড়ছে৷ আসলে সীমান্ত হত্যার পিছনে আসল কারণ হলো ভারতের মনোভাব৷ ভারত কাশ্মিরসহ পাকিস্তান সীমান্তে নিয়োজিত বিএসএফ সদস্যদের এখনো ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বাংলাদেশ সীমান্তে নিয়োগ করে৷ তাদের অধিকাংশই বাংলা ভাষাভাষী নয়৷ তাদের মনোভাব যুদ্ধংদেহী৷ ফলে পরিস্থিতির কোনো উন্নতি হচ্ছে না৷”
বিএসএফ-এর দেওয়া তথ্য অনুসারে, ভারত থেকে ২০১৩ সালে ২২ লাখ গরু বাংলাদেশে পাচার হয়৷ ২০১৪ সালে তা কমে দাঁড়ায় ১৮ লাখে৷ আর ২০১৫ সালে পাচার হওয়া গরুর সংখ্যা সাড়ে চার লাখ৷
আব্রাহাম লিংকন বলেন, ‘‘আসলে গরু চোরাচালান নয়, মূল বিষয় হলো মানসিকতা৷ মানসিকতার পরিবর্তন না হলে সীমান্ত হত্যা কমবে না৷ সীমান্তে দুই দেশের মানুষেরই কিছু সাধারণ বিষয় আছে৷ তাই সীমান্ত হাটগুলো সত্যিকার অর্থে কার্যকর করতে হবে৷ তাছাড়া সীমান্তে চোরাচালান বন্ধে বাংলাদেশকেও সক্রিয় ভূমিকা পালন করতে হবে৷ ভারতকে বুঝতে হবে যে, সীমান্ত হত্যা সীমান্তে জঙ্গি তৎপরতা উসকে দিতে পারে, যা দু’দেশের জন্যই অকল্যাণকর৷”
আব্রাহাম লিংকনের কথায়, ‘‘মানবাধিকার কী – সেটা সীমান্তরক্ষীদের বুঝতে হবে৷ কিন্তু তারা শুধুই যুদ্ধ বোঝেন৷” আর নূর খানের কথায়, ‘‘দু’দেশের শীর্ষ পর্যায়ে সীমন্ত হত্যা নিয়ে আরো বৈঠক হওয়া প্রয়োজন৷ দুই দেশের মানুষের কল্যাণের জন্য সত্যিকার অর্থেই সীমান্ত হত্যাকাণ্ড শূন্যের কোঠায় নামিয়ে আনতে হবে৷”
প্রসঙ্গত, বাংলাদেশ ও ভারতের মধ্যে ৪,০৯৬ কিলোমিটার সীমান্ত রয়েছে, যা পৃথিবীর পঞ্চম বৃহত্তম স্থল সীমান্ত৷ বাংলাদেশের সঙ্গে ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম, মেঘালয়, ত্রিপুরা এবং মিজোরাম রাজ্যের সীমান্ত রয়েছে৷ শুধু পশ্চিমবঙ্গের সাঙ্গেই ২,২১৭ কিমি. সীমান্ত আছে বাংলাদেশের৷
উৎসঃ জার্মান বাংলা রেডিও dw.com
রিলেটেড নিউজ
- India’s great wall – the world’s deadliest frontier, Channel 4 UK, 23 July 2009
Fortress India is building a new fence along the Bangladeshi border and over a thousand miles have been completed so far. The project, which began in 2000, is inspired by Israel’s wall in the West Bank, and since the killing of over 170 people by Islamist militants in Mumbai last November, construction is accelerating.
80,000 Indian soldiers of the Border Security Force, or BSF, are standing guard along the border with Muslim Bangladesh; and when it is finished, the fence will be as long as America’s 2,000-mile border with Mexico.
- সীমান্তে হত্যা : বাংলাদেশ-ভারত বন্ধুত্ব!, দৈনিক পুর্বকোণ, জুলাই ৮, ২০১৫
এক পরিসংখ্যানে দেখা গেছে, ২০০০ সাল থেকে ২০১৪ সাল পর্যন্ত বিএসএফের গুলিতে বিভিন্ন সীমান্তে ১ হাজার ৩৫ জন বাংলাদেশি নিহত ও ৯১৯ জন আহত হয়েছেন। সমঝোতা এবং চুক্তি লঙ্ঘন করে বিএসএফ সীমান্তে নিরস্ত্র বাংলাদেশিদের গুলি করে হত্যা করছে ও অবৈধভাবে বাংলাদেশ সীমান্ত পেরিয়ে বাংলাদেশি নাগরিকদের ধরে নিয়ে যাচ্ছে এমন ঘটনা প্রায়ই ঘটছে। যা আন্তর্জাতিক আইন ও মানবাধিকারের লঙ্ঘন এবং বাংলাদেশের সার্বভৌমত্বের প্রতি হুমকি স্বরূপ।
-
বিশ্বের সবচেয়ে প্রাণঘাতী সীমান্ত, প্রথম আলো, সেপ্টেম্বর ১৫, ২০১৩
চ্যানেল ফোরের রিপোর্টেরও দেড় বছর পর ২০১০ সালের ৯ ডিসেম্বরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষী বাহিনীর এ ধরনের নির্বিচার হত্যাকাণ্ডের বিষয়ে ‘ট্রিগার হ্যাপি’ শিরোনামে বিশদ আকারে একটি প্রতিবেদন প্রকাশ করে হিউম্যান রাইটস ওয়াচ। তাদের প্রতিবেদনে বলা হয়, এই শতকের প্রথম ১০ বছরে ভারতীয় সীমান্তরক্ষীদের নির্বিচার গুলিবর্ষণে নিহত হয়েছেন এক হাজারের মতো বাংলাদেশি, যার অর্থ হচ্ছে গড়ে প্রতিবছর ১০০ জন অর্থাৎ প্রতি সাড়ে তিন দিনে একজন করে বাংলাদেশি নিহত হয়েছেন। কোনো ধরনের যুদ্ধবিগ্রহ ছাড়া শান্তির সময়ে কোনো দেশ তার প্রতিবেশী রাষ্ট্রের নাগরিকদের এই হারে হত্যা করছে—এটা কোনো গণতান্ত্রিক রাষ্ট্রের নেতৃত্ব এবং নাগরিক সমাজ বিনা বাক্যব্যয়ে মেনে নেবে তা কল্পনা করাও দুষ্কর। দুর্ভাগ্যজনকভাবে ভারতেও যেমন বিষয়টি উপেক্ষিত থেকে গেছে, তেমনি বাংলাদেশের রাজনীতিকেরা এর ভয়াবহতা বুঝতে ব্যর্থ হয়েছেন। কাঁটাতারের বেড়ায় ঝুলে থাকা ফেলানীর নিথর দেহের ছবি সাময়িকভাবে আমাদের কিছুটা বিচলিত করলেও সীমান্তে মানুষ হত্যা বন্ধের বিষয়টিকে যথেষ্ট গুরুত্ব দিতে সবাই ব্যর্থ হয়েছেন। এই ব্যর্থতা শুধু ক্ষমতাসীনদের একার নয়, এর আগে যাঁরা ক্ষমতায় ছিলেন তাঁদেরও।
ফেলানী হত্যার বিচার বিএসএফের আদালতে না করে ফৌজদারি আদালতে অনুষ্ঠানের জন্য ভারতের কাছে বাংলাদেশ কোনো দাবি জানিয়েছিল কি না, তা স্পষ্ট নয়। নাকি সরকার আশা করেছিল বিএসএফ তাদের নিজেদের বিচারে নিজেদের দোষী সাব্যস্ত করবে? ‘সীমান্তে সন্দেহভাজনদের গুলি করা বন্ধ হবে না’ মর্মে বিএসএফের সাবেক প্রধান ইউ কে বনশলের বহুল প্রচারিত বক্তব্য (ফেব্রুয়ারি ৭, ২০১২ বিবিসি) বাংলাদেশের কর্তাব্যক্তিরা কি ভুলে গিয়েছিলেন? ফেলানীর হত্যাকারী তো তাঁর বাহিনীপ্রধানের নির্দেশনাই অনুসরণ করেছেন। তাহলে সেই বাহিনীর আদালত কেন তাঁকে দোষী সাব্যস্ত করবেন?
২০১১ সালের ২৫ জুলাই হিউম্যান রাইটস ওয়াচ ভারতীয় প্রধানমন্ত্রী মনমোহন সিংয়ের কাছে চিঠি দিয়ে সীমান্তে নতুন করে হত্যা এবং নির্যাতনের যেসব অভিযোগ উঠেছে, সেগুলোর দ্রুত ও স্বচ্ছ ফৌজদারি তদন্ত এবং ন্যায়বিচার দাবি করেছিল। ওই চিঠিতে তারা বলেছিল, ‘শ্রীলঙ্কার সমুদ্রসীমায় প্রবেশের কারণে ভারতীয় জেলেদের বিরুদ্ধে কলম্বো কোনো পদক্ষেপ নিলে ভারত যখন প্রতিবাদ করে, তখন তাদেরই সীমান্তরক্ষী বাহিনী বাংলাদেশিদের বিরুদ্ধে অপরাধ করলে তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নিতে তাদের এত দ্বিধা কেন?’ এ ধরনের যুক্তি বাংলাদেশের কর্মকর্তাদের কণ্ঠে শোনা যায় না। বন্ধুরাষ্ট্রের কাছে এটুকু নৈতিক অবস্থান তুলে ধরতে না পারলে সেই সম্পর্কে বন্ধুত্বের আর কি অবশিষ্ট থাকে?
- বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে মানুষ হত্যা কি বন্ধ হবে না?, যুগান্তর ২৬ জুন ২০১৩
যৌথভাবে প্রকাশিত ভারতের মানবাধিকার সংস্থা ‘মাসুম’, বাংলাদেশের ‘অধিকার’ ও আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা হিউম্যান রাইটস ওয়াচের প্রতিবেদনে দেখা যায়, গত ১২ বছরে বাংলাদেশ-ভারত সীমান্তে বিএসএফ কর্তৃক প্রায় ১০৫০ বাংলাদেশীকে হত্যা করা হয়েছে। অপহরণ ও আহতের সংখ্যা ১৫০০-এর কাছাকাছি। সংস্থা তিনটির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিগত ১৩ বছরে এমন একজন বাংলাদেশী পাওয়া যায়নি, যে সীমান্ত অতিক্রমের সময় সঙ্গে অস্ত্র বহন করেছে। বড়জোর তাদের হাতে লাঠি বা কাস্তে ছিল। এছাড়া বিএসএফের বিরুদ্ধে নিরীহ বাংলাদেশীদের ওপর নির্মম নির্যাতনেরও অভিযোগ রয়েছে।
ভারতকে বুঝা সিরিজের বাকী পোস্টগুলো;