আগের পোষ্টঃ জামায়াতবাদের সংকট-২
বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামীতে সংস্কার নিয়ে চিন্তা করছেন অনেকে।এই পোষ্টে সংক্ষেপে সংস্কারপন্থি ধারাগুলো চিহ্নিত করার চেষ্টা করা হয়েছে।সংস্কারবাদীরা নিজেরাই যে সংকটের অংশ সেই বিষয়টা আলোচনা করতেই এই পোষ্ট।
মাঠের নেতা-কর্মি, প্রবাসে অবস্থানরত সাবেক নেতা-কর্মি, নিষ্ক্রিয় নেতা কর্মিরা বিভিন্ন দৃষ্টিকোন থেকে সংস্কারের প্রয়োজনীয়তা অনুধাবন করেন। তবে সংস্কারের কারন ও প্রয়োজনীয়তা নিয়ে যে চিন্তাগুলো এখানে সেখানে দেখা যায় তার মধ্যে কোন মতৈক্য প্রতিষ্ঠিত হয়েছে এমনটা বলা যায়না। কিছু সংস্কার চিন্তা আছে সমসাময়িক ক্রান্তিকালকে ঘিরে এবং সেটা থেকে উত্তরণের উপায় হিসেবে প্রস্তাবনা আকারে। আবার কিছু সংস্কার প্রস্তাবনা আছে দীর্ঘমেয়াদী লক্ষ্য ও উদ্দেশ্য অর্জনের লক্ষ্যে। কিছু সংস্কার প্রস্তাব দেখা যায় রাজনৈতিক সফলতাকে ত্বরান্বিত করার প্রচেষ্টা হিসেবে। কিছু রয়েছে স্রেফ দ্বীন-ইসলাম মানুষের কাছে পৌঁছে দেয়ার প্রচেষ্টা হিসেবে।আবার কিছু প্রস্তাবনা রয়েছে জামায়াত-শিবিরের আভ্যন্তরীণ অবকাঠামোগত সংস্কারের লক্ষ্যে। সংস্কার প্রস্তাব ও সংস্কার পন্থিদের প্রস্তাবনাকে আমার বিবেচনায় নিম্নোক্ত কয়েক শ্রেণীতে ভাগ করা যায়;
১।যারা মনে করেন জামায়াতের কৌশলগত ও কার্যপদ্ধতিগত কিছু বিষয়ে পরিবর্তন আনলেই বর্তমান সমস্যা সমাধান হয়ে যাবে এবং দ্রুত রাজনৈতিক ফায়দা হাসিল হবে।এখানে ক্ষমতা মুখ্য।এই গ্রুপের সংস্কারপন্থিরা জামায়াতকে গন মানুষের দল হিসেবে দেখতে চান। তাদের কেউ কেউ মনে করেন জামায়াতের ৭১ সাল কেন্দ্রিক সমস্যা যেহেতু জামায়াতকে বিপর্যস্ত করে ফেলেছে,সেহেতু এই বিষয়ের একটা সুরাহা হলেই জামায়াত বেঁচে যাবে।তাদের কেউ কেউ আবার নতুন রাজনৈতিক ফ্রন্ট গঠনের প্রস্তাব রাখেন। কেউ কেউ জামায়াতেরই নাম পরিবর্তনের প্রস্তাবনা করেন।
২।আরেক গ্রুপের সংস্কারপন্থিরা মনে করেন বাহ্যিক চ্যালেন্জ যত কঠিনই হোক সেটা মোকাবেলা করা অসম্ভব নয় যদি জামায়াতের আভ্যন্তরীণ কিছু বিষয়ে সংস্কার আনা যায়।তারা এক্ষেত্রে ক্যাডার সিস্টেম, নেতৃত্ব নির্বাচনের পদ্ধতি ও জবাবদিহীতা, আভ্যন্তরীণ প্রতিষ্ঠানগুলোতে পরিবর্তন আনার কথা বলেন।এক্ষেত্রে তারা প্রথম গ্রুপের বক্তব্যের বাড়তি হিসেবে বিভিন্ন আন্তর্জাতিক ইসলামী আন্দোলনের অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা ও কৌশল নেয়ার পক্ষে মত দেন।
৩। তৃতীয় আরেকটি ছোট্ট গ্রুপ মনে করেন জামায়াতের উচিত তাদের মৌলিক রাজনৈতিক আকিদা ও আদর্শের পর্যালোচনা করা এবং পরিবর্তনের চেষ্টা করা।এই গ্রুপের কর্মিরা মনে করেন তাত্ত্বিকভাবে মাওলানা মওদুদীকে আঁকড়ে থাকার ফলে জামায়াত অন্যান্য ইসলামী দলগুলোর সাথে ঐক্যে যেতে পারছেনা।সে জন্য তারা তত্ত্বগত পর্যালোচনা করে নতুন কনসেপ্ট তৈরির পক্ষে প্রস্তাবনা পেশ করতে চান।
৪। আরেকটি গ্রুপ রয়েছেন যারা মনে করেন বিদ্যমান জামায়াতে সংস্কার আনা সম্ভব নয়। কারন অতীতে বহু চেষ্টা করেও কোন মৌলিক সংস্কার আনা সম্ভবপর হয়নি।যার ফলে এই জামায়াত দিয়ে ইসলামী আন্দোলন অথবা রাজনীতি কোনটাই ভালভাবে হবেনা।তারা জামায়াতের ব্যাপারে আশাহত।তবে অন্য কোন দলে তাদের পক্ষে যাওয়াও সম্ভব নয়।ফলে নিষ্ক্রিয়।তারা হয়ত অন্য দলে যোগ দিয়ে বিকল্প রাজনীতি করবেনা বরং সাংস্কৃতিকভাবে জামায়াত ঘরানার হয়ে থাকতে চান।
৫। চতুর্থ গ্রুপের মত ছোট্ট আরেকটি গ্রুপ রয়েছে যারা বিদ্যমান জামায়াতে সংস্কারের সম্ভাবনা দেখেননা। তাদের প্রস্তাবনা হচ্ছে জামায়াতকে নিজ জায়গায় রেখে, বৈশ্বয়িক অবস্থা মাথায় রেখে, পুরো বাংলাদেশের সকল পথের মতের মানুষের কথা মাথায় রেখে সম্পূর্ন ভিন্ন রাজনীতি করা সময়ের দাবী। তারা বলার চেষ্টা করছেন যে সরাসরি ইসলাম ট্যাগ বিহীন বিকল্প পার্টি গঠন করে বাংলাদেশে একটি তৃতীয় শক্তিকে রাজনীতিতে নিয়ে আসা সম্ভব।এ গ্রুপটি বিএনপি’র নিষ্ক্রিয়তাকে কাজে লাগাতে চান।তবে এটা যেহেতু একক বা ছোট্ট গ্রুপ দিয়ে হবেনা সেহেতু তারা কালচারগত জামায়াত ঘরানার যারা আছেন এবং যারা এক সময় শিবির করতেন কিন্তু বর্তমানে নিষ্ক্রিয় তাদেরকে জাগ্রত করার চিন্তা করেন।
উপরোক্ত ৫ গ্রুপের সবাই সবার সংস্কার প্রস্তাবের সাথে একাত্মতা প্রকাশ করেন তা নয়।যদিও তাদের গন্তব্য হয়ত এক কিন্তু মতের ভিন্নতার কারনে তারা একে অপরকে সন্দেহের চোখেও দেখেন বলে কথিত আছে।কিন্তু একটি বিষয় সবার ক্ষেত্রেই হয়ত প্রযোজ্য যে, তাদের কারো মাঝেই সংস্কারের মৌলিক কোন রুপরেখা নেই।সংস্কার কেন দরকার হয়ত এটা তারা বলেন, কিন্তু কিভাবে হবে, কোথা থেকে শুরু হবে, সংস্কারের পদ্ধতি এবং প্রক্রিয়া নিয়ে কোন কার্যক্রম চোখে পড়েনা। এই জন্যই হয়ত সংস্কারপন্থিদের সমালোচনায় নিন্মোক্ত মন্তব্য করেছেন চট্রগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের দর্শনের সহকারী অধ্যাপক মোহাম্মদ মোজাম্মেল হক;
জামায়াতের সংস্কারপন্থীদের বড় দূর্বলতা হচ্ছে, তারা সবাই মিলে is a big zero …! জামায়াতও এটি ভালো করে জানে।কথাটা খুব রূঢ় শোনালেও এটি বাস্তব। ইনাদের জামায়াত বিরোধিতার বেসিক ক্যারেকটার হলো বড় ভাইয়ের বিরুদ্ধে ছোট বোনের রাগ–গোস্বা বা অভিমানের মতো। দিনশেষে তারা সবাই জামায়াত।
সংস্কার বিরোধীতা ও তার কারন
মজার ব্যাপার হচ্ছে ৫ গ্রুপের বাহিরেও জামায়াতপন্থি লোকজন আছে, যাদের কেউ কেউ সংস্কার বিরোধী। জামায়াতে যারা চাকুরী করেন অথবা জামায়াত যাদের রুটি রুজির উৎস তারা স্বভাবতই এই গোত্রের অন্তর্ভুক্ত। তাঁদের সংস্কার বিরোধিতার কিছু কারন সংক্ষেপে উল্লেখ করা যাক।
- মানুষের উপর আস্থার সংকট
- আভ্যন্তরীন কালচারঃ অতিমাত্রায় গোপনীয়তার নীতি
- আত্মিক সঞ্চয় হারানোর ভয়
এই তিনটি বিষয় সংস্কারের পক্ষ-বিপক্ষ সব জামায়াতীর জন্যই কম বেশি প্রযোজ্য। এই সিরিজের ২য় পর্বে এই বিষয়গুলো আলোচিত হয়েছে (দেখুন জামায়াতবাদের সংকট-২)।
- অর্থনৈতিক কারনঃ প্রফেসর হাসান মোহাম্মদ জামায়াত নিয়ে লেখা “জামায়াতঃ সংগঠন ও নেতৃত্ব” গ্রন্থে এবং প্রফেসর ভুইয়্যা মনোয়ার কবীর তার “Politics and the Development of the Jamaat e Islami Bangladesh” নামক গবেষণায় দেখিয়েছেন যে জামায়াত- শিবিরের নেতা-কর্মিদের বেশির ভাগই আসে নিম্ন মধ্যবিত্ত অথবা মধ্যবিত্ত পরিবার থেকে। এই নেতা কর্মিদের অর্থনৈতিক নিশ্চয়তা যদি জামায়াত ও তার পরিচালিত, অধীনস্থ কোন প্রতিষ্ঠান থেকে পায় তার পক্ষে জামায়াতকে রক্ষা করা নৈতিক দায় হয়ে পরে।দলের শুরা বা নেতৃত্বের একটা অংশগ্রহন অর্থনৈতিক ইন্টারেষ্টের সাথে অন্তর্ভুক্ত হয়ে একটি স্বতন্ত্র স্বার্থান্বাষী গোষ্ঠী (stakeholder) হিসেবে আবির্ভূত হয়েছে। এভাবে জামায়াতের মধ্যেই গড়ে উঠেছে একটি শ্রেণী যারা প্রতোক্ষ ও পরোক্ষভাবে জামায়াতের উপর নির্ভরশীল।এই শ্রেণীকে সংজ্ঞায়িত করা যায় সংগঠনবাদী (Establishment) হিসেবে।
পরের পর্বে সংস্কার বিরোধীদের বিরোধীতার আরো কিছু মনস্তাত্বিক কারন নিয়ে আলোচনা করার ইচ্ছা রইল।
মজার ব্যাপার হচ্ছে সংগঠনবাদী এই শ্রেণীর নেতৃত্বেই বাংলাদেশ ডেভেলপমেন্ট পার্টি (বিডিপি) নামে নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের চিন্তা ভাবনার খবর আজ দিয়েছে প্রথম আলো।
রিপোর্টটি সত্য কি মিথ্যা সেটা বুঝতে বেশি সময় লাগবেনা।সেজন্য তর্কও অর্থহীন।যদি রিপোর্ট সত্য হয়ও তাহলে তাদেরকে আমার বিবেচনায় উপরোক্ত সংস্কারপন্থি ৫ গ্রুপের ১ম গ্রুপে রাখব। প্রশ্ন হচ্ছে, এতে কি বাকী ৪ গ্রুপের সংস্কারবাদীদের লক্ষ্য অর্জিত হবে বা তারা কি খুশি মনে প্রণোদনা নিয়ে কাজে ঝাঁপিয়ে পরবেন?
(চলবে)