ভূমিকা
বিগত তিন দশক ধরে চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ে আমি জামায়াত-শিবিরের নেতৃস্থানীয় ব্যক্তি হিসাবে পরিচিত। একনিষ্ঠভাবে ‘সাংগঠনিক কাজ’ করার পাশাপাশি ছাত্রজীবন হতে আমি বুদ্ধিবৃত্তি চর্চা বলতে যা বুঝায় তার সাথে সম্পৃক্ত ছিলাম। তাই জামায়াতের সংস্কারপন্থা টাইপের কিছুতে আমার অগ্রগণ্য ভূমিকা থাকার কথা ছিলো। ২০০৯-১০ হতে সংস্কারবাদী হিসাবে পরিচিত দেশ-বিদেশে অবস্থানরত বিশেষ করে উচ্চশিক্ষিত জামায়াত নেতা-কর্মীদের সাথে আমার এক ধরনের যোগাযোগ গড়ে উঠে।
চলমান সরকারী দমন-পীড়নের মুখে জামায়াত বা যে কোনো সংগঠনের কম-বেশি কোনঠাসা হওয়াই ছিলো স্বাভাবিক। অথচ, বহুস্তরের নেতৃত্ব ও পর্যাপ্ত প্রস্তুতি থাকার গালগল্পকে মিথ্যা প্রমাণ করে চলমান দমন অভিযানের শুরুতেই জামায়াতের সাংগঠনিক কাঠামো কার্যত মুখ থুবড়ে পড়েছে। তাছাড়া দীর্ঘ অর্ধশতাব্দী পরও ‘যোগ্য’ জনশক্তি, বুদ্ধিবৃত্তিক মান ও গণভিত্তির লক্ষ্য অর্জিত না হওয়াও হতাশাজনক ব্যাপার। কেন এমন হলো? কী করা যায়? ইত্যাদি নানা বিষয়ের ক্ষেত্র ও মাত্রা বিবেচনায় আমার স্বভাবতই জামায়াতের সংস্কারবাদী হওয়ার কথা ছিলো।
বিগত কয়েক বছর হতে, অধিকতর সুনির্দিষ্ট করে বললে ২০১৩ সাল হতে আমার জামায়াত-পরিচয়কে পাশ কাটিয়ে (disown) ইসলামী আদর্শের আওতায় একটি ভারসাম্যপূর্ণ সমাজ গঠনের রূপরেখা নির্মাণের কাজ শুরু করি। যারা আমার জীবনের এই নতুন অধ্যায় সম্পর্কে জানেন না, বা জানলেও স্বতন্ত্র অবস্থান হতে কাজ করাটাকে আমার স্বভাবসুলভ সরলতা বা আবেগপ্রবণতার কারণে অসম্ভব মনে করেন, কিংবা একে কৌশলমাত্র মনে করেন তারা আমাকে জামায়াত ছাড়া ভাবতে পারেন না। অভিজ্ঞতায় দেখেছি, বড়জোর তারা আমাকে জামায়াতের সংস্কারবাদীদের মধ্যে গণ্য করেন। এই ধারণাটি ভুল। না, আমি জামায়াতের সংগঠনবাদী বা সংস্কারবাদী –কোনো ধারার সাথে একমত নই।
এ দেশের মানুষ সাধারণত ব্যক্তি, প্রতিষ্ঠান বা সংগঠন বিশেষ সম্পর্কে হুইমজিক্যালি কিছু গড়পরতা ধারণা পোষণ করে। এটি তাদের নন-একাডেমিক ও ওভার-পলিটিসাইজড মন-মানসিকতার কারণে হয়ে থাকে। আমার সম্পাদিত ‘কামারুজ্জামানের চিঠি এবং জামায়াতের সংস্কার প্রসঙ্গ’ শীর্ষক একটা বই গত বছর সিএসসিএস পাবলিকেশন হতে প্রকাশিত হয়। এতে অনেকে ধরে নিয়েছেন, আমি আসলে জামায়াতের সংস্কারবাদীদেরই একজন। অথচ এই সংকলনে সংস্কার নিয়ে জামায়াতের শীর্ষ নেতৃবৃন্দের মধ্যে যে আভ্যন্তরীণ বিরোধ, তার একটি পক্ষপাতহীন ও ধারাবাহিক চিত্র তুলে ধরা হয়েছে মাত্র। শুধুমাত্র আগ্রহী ও গবেষকদের সুবিধার্থে এটি সংকলন করা হয়েছে। ব্যাপারটি এর বেশি কিছু নয়।
জামায়াত সংস্কার নিয়ে আমার ফোর পয়েন্টস –
২০১০ সাল হতে আমি ব্লগ লিখে আসছি। তখন থেকেই প্রসঙ্গক্রমে জামায়াতের বিষয়ে লেখালেখি করছি। জামায়াতের সংস্কার প্রসংগ আসলেই আমি ‘ফোর পয়েন্টস’ হিসাবে এই কথাগুলো সব সময়েই বলেছি:
(১) জামায়াত কখনো কোনো মৌলিক সংস্কারকে গ্রহণ করবে না। অথচ
(২) জামায়াতের বিকল্প কিছু করাটাও নানা কারণে সম্ভব নয়।
(৩) ইসলামকে ‘ইসলামী আন্দোলন’ হিসাবে যারা বুঝেছে তাদের পক্ষে কিছু না করে বসে থাকাও অসম্ভব। অতএব
(৪) প্রত্যেকেরই উচিত নিজ নিজ ক্ষেত্র ও পরিসরে সাধ্য মোতাবেক কিছু না কিছু কাজ শুরু করা। বিশেষ করে কনসেপ্ট বিল্ডআপের কাজ করে যাওয়া। শেষ পর্যন্ত জামায়াত সংশোধন হবে, নাকি নতুন কোনো ধারা তৈরি হবে, নাকি উভয়টাই ঘটবে – তা কেবলমাত্র ভবিষ্যতই বলে দিবে।
আমার বর্তমান কাজের উদ্দীষ্ট জনশক্তি কারা?
অতএব, দেখা যাচ্ছে আমি কখনোই নিজেকে জামায়াতের সংস্কারবাদী হিসাবে মনে করি নাই। গোড়া থেকেই অর্থাৎ তাত্ত্বিক ভিত্তির পুনর্গঠন হতেই কাজ করতে হবে – এটি আমি বরাবরই বিশ্বাস করেছি। সে জন্য জামায়াত শুধু নয়, যারা কোনো না কোনোভাবে কোনো সংগঠন ও সাংগঠনিক ব্যবস্থার সাথে জড়িত তাদেরকে উদ্দীষ্ট জনশক্তি হিসাবে বিবেচনা না করে আপাতদৃষ্টিতে নিরপেক্ষ অবস্থানে থাকা এ দেশের ১৫% লোককে আমি টার্গেট করে কাজ শুরু করেছি। বিশেষ করে এই শতকরা পনের ভাগের মধ্যকার তরুণ ছাত্র-ছাত্রীদেরকে অন্য যে কোনো জনগোষ্ঠীর তুলনায় অধিকতর সম্ভাবনাময় হিসাবে গুরুত্ব দিয়ে আসছি।
এই ইয়াং গ্রুপকে প্রায়োরিটি দিতে গিয়ে, কনভিন্স করতে গিয়ে প্রসংগক্রমে অপরাপর ইসলামপন্থীদের সাথে এই নতুন ধরনের কাজের পার্থক্য নিয়ে কথা বলতে হয়। তারই অংশ হিসাবে ‘কেন আমি জামায়াতের সংস্কারবাদী নই’ – তা নিয়ে এই নোট।
জামায়াতের সংস্কারবাদীদের ব্যাপারে আমার আপত্তির বিষয়সমূহ –
জামায়াতের সংস্কারবাদীদের যেসব কমন বৈশিষ্ট্যকে আমি কোনোক্রমেই সঠিক মনে করি না তার মধ্যে আছে:
(১) কর্ম তৎপরতার দিক থেকে তারা সমালোচনায় যত পটু বাস্তবে লেগে থেকে গঠনমূলক কিছু করার ব্যাপারে তারা ততটাই বিমুখ।
(২) দ্বীনি তথা ধর্মীয় দিক থেকে তারা কম-বেশি শুদ্ধতাবাদী (puritanic) যা বাহ্যত আহলে হাদীস ও সালাফি পন্থার সাথে সাদৃশ্যপূর্ণ।
(৩) বুদ্ধিবৃত্তিক দিক থেকে তারা প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে ‘সহজিয়া-সাম্যবাদী’ ফরহাদ মজহারের দ্বারা প্রভাবিত।
(৪) জামায়াতের সংস্কারবাদীরা মনে করে জামায়াতের যত সমস্যা তা মূলত পরিচালনাগত সমস্যা (operative or procedural problem)।
(৫) রাজনৈতিক সংস্কার তথা রাজনীতিই তাদের উক্ত বা অনুক্ত লক্ষ্য।
(৬) টাকা-পয়সার দিক থেকে তারা তারিক রমাদানের ভাষায় ‘হালাল ক্যপিটালিজমে’র একনিষ্ঠ অনুরক্ত, ভক্ত ও অনুসারী।
এ সব পয়েন্টের ওপর আমি সংক্ষেপে কিছু বলার চেষ্টা করবো।
১.০ কর্মবিমুখ বাকপটুতা
জামায়াতের সংস্কারবাদীদেরকে যদি জামায়াতের কী কী ভুল ও সমস্যা রয়েছে তা সম্পর্কে বলতে দেয়া হয় তাহলে মাশাআল্লাহ তারা সুপার-ডুপার-হাইপার একটিভ হয়ে যাবেন। জামায়াতকে তুলাধুনা করতে করতে তাদের দিনরাত পার হয়ে যাবে। এ কাজে তাদের কোনো ক্লান্তি নাই। এমনকি, বলা যায়, তাদের কোনো লজ্জা-শরমও নাই। নিজ নিজ সাংগঠনিক জীবনের কতো সব কৃতিত্ব, তদীয় দায়িত্বশীলদের নিয়ে তাদের যত সব আপত্তি ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতে বলতে তাদের মুখে যেন খৈ ফোটে …!
১.১ নেতা–কর্মীদের নিয়েই সংগঠন
জামায়াত তথা কোনো সংগঠন ও সাংগঠনিক ব্যবস্থা আসমান হতে নাযিল হয় না। জমি ফুঁড়েও উঠে না। নেতা-কর্মীদের নিয়েই সংগঠন। অতএব জামায়াতের যা ভালোমন্দ তার কৃতিত্ব ও দায়দায়িত্ব আনুপাতিক হারে এর নেতা-কর্মীদের ওপরও বর্তায়। জামায়াতের যেসব ভুল তার দায় বহন করতে প্রস্তুত না থাকলেও সে সব ভুল হতে পরিত্রাণ লাভের জন্য যা করণীয় তার একটা আনুপাতিক অংশ তো সংস্কারবাদী-সংগঠনবাদী নির্বিশেষে প্রত্যেকের ওপরই বর্তায়। তাই না? সংস্কারবাদীদেরকে দেখেছি, তারা দোষারোপ চর্চায় যতটা ত্বড়িৎকর্মা ও ক্লান্তিহীন, নিজ নিজ ন্যূনতম দায়িত্ব স্বতঃস্ফূর্তভাবে পালনের ব্যাপারে ততটাই অনিচ্ছুক ও পলায়নপর।
১.২ সংস্কারবাদীদের অজুহাতের শেষ নাই
কিছু করার কথা বললে তারা কৌশল হিসাবে নিজেকে হেয় করতেও পিছপা হন না। এ ধরনের লোকেরা আমার সাথে এনগেজ হলে এক পর্যায়ে বলে বসেন, “আপনি পারেন। করছেন। আমি দুর্বল। আপনার মতো অতোটা বেপরোয়া নই। তাছাড়া আমার অনেক সমস্যা। এসব কাজ একা একা হয়ও না”, ইত্যাদি।
১.৩ everybody’s business is no body’s business অথবা রাজার পুকুরে দুধ ঢালার গল্প
সংস্কারবাদীদের বদ্ধমূল ধারণা হলো অন্য সবাই এগিয়ে না আসলে একা একা কিছু করা সম্ভব না। শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটি রাজার পুকুরে দুধ ঢালার মতো হয়ে দাড়ায়। গল্পটা হলো এ রকম: কোনো এক রাজা দুধের পুকুরে গোসল করতে চাইলেন। সে মোতাবেক একটা পুকুর খনন করা হলো। অতঃপর তিনি রাজ্যের সব গোয়ালাকে হুকুম দিলেন যাতে তারা রাতের মধ্যে প্রত্যেকে এক গামলা দুধ ওই পুকুরে ঢেলে আসে। রাজা মশাই যথারীতি পরদিন দুধের পুকুরে গোসল করতে গিয়ে দেখেন পুকুরটা একেবারেই শুন্য, কোনো দুধ নাই। কী ব্যাপার? অবশেষে জানা গেলো, প্রত্যেক গোয়ালাই মনে করেছে, সবাই তো দুধ ঢালবে। আমার এক গামলা না ঢাললেও বা কী আসে যায় …। এবার বুঝুন ….। কথায় বলে, ছোট ছোট বালুকণা বিন্দু বিন্দু জল, গড়ে তোলে মহাদেশ সাগর অতল।
১.৪ প্রত্যেক ব্যক্তিই নিজ নিজ অবস্থান হতে বিশেষ ভূমিকা রাখার যোগ্যতা রাখে –
আল্লাহ তায়ালা প্রত্যেক মানুষকে স্বতন্ত্রভাবে সৃষ্টি করেছেন। আমার কাজ আপনাকে দিয়ে হবে না, আবার আপনার কাজ আমাকে দিয়ে হবে না। প্রত্যেক মানুষ তো বটেই, দুনিয়াতে আল্লাহ তায়ালা কোনো কিছুকেই নিরর্থক সৃষ্টি করেন নাই। আর দায়দায়িত্বের দিক থেকে বললে তো সেই হাদীসটিই আমাদের পথনির্দেশক হতে পারে যাতে বলা হয়েছে যে, সাবধান, তোমরা প্রত্যেকেই দায়িত্বশীল। প্রত্যেককেই নিজ নিজ দায়িত্ব সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ করা হবে।
আল্লাহ তায়ালা আমাদের যে শক্তি সামর্থ্য দিয়েছেন তা সম্পর্কে তিনি আমাদের জিজ্ঞাসাবাদ করবেন। অন্য কারো দায় কোনো ব্যক্তির ওপর বর্তাবে না। বলাবাহুল্য, চেষ্টাটাই মুখ্য, সাফল্য লাভের বিষয়টা নিতান্তই গৌণ, যদিও সাফল্য লাভের জন্য সর্বাধিক উপযোগী পন্থাতেই কর্মতৎপর হতে হবে।
১.৫ কোরাইশদের মতো জামায়াতের সংস্কারবাদীরা নিরাপদে থেকেও হাত–পা গুটিয়ে বসে আছেন –
আল্লাহ তায়ালা কোরাইশদেরকে শীত ও গ্রীষ্মে তথা সারা বছর আরবের অনিরাপদ এলাকায় নিরাপত্তা লাভের কথা স্মরণ করিয়ে দিয়েছেন। যাতে তারা আল্লাহর কথা স্মরণ করে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করে। আল্লাহ তায়ালার প্রতি শুকরিয়া জ্ঞাপনের প্রমাণ হলো নিজ নিজ সামর্থ্যের সবটুকু দিয়ে কর্মতৎপর হওয়া। আমি অবাক হয়ে দেখি সারা দেশের বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক পর্যায়ে কর্মরত সহস্রাধিক ভেটেরান জামায়াত পিপল চলমান দমন-পীড়নের মধ্যেও যথেষ্ট নিরাপদ আছেন। উনারা সব কাজই করছেন। যারা রুকন, ভেতরে ভেতরে উর্ধ্বতনদের কাছে কিছু কাগুজে রিপোর্ট পাঠানো ব্যতিরেকে তারা এবং বাদবাকি বিরাট সংখ্যক জনশক্তি কার্যত সম্পূর্ণ নিষ্ক্রিয় হয়ে বসে আছেন।
জামায়াতের সংস্কারের কথা দিনরাত জপতে থাকলেও নিজেদেরকে এক একটি থিংক-ট্যাংক বা চিন্তা-বলয় হিসাবে গড়ে তোলার কাজে উনারা ধারেকাছেও নাই। চাপিয়ে দিয়ে চিন্তা ও সৃজনশীলতা গড়ে তোলা যায় না। মেধাবীরা নিজ গুণেই নতুন জ্ঞান তৈরি করেন, অন্তত করার কথা। কবে উর্ধ্বতন জামায়াত নেতৃত্ব উনাদেরকে কোনো প্রাসঙ্গিক বিষয়ে চিন্তা করতে বলবেন, সেজন্য যেন উনারা বসে আছেন। কী অবাক কাণ্ড! আশ্চর্য!
১.৬ অনিচ্ছুক ঘোড়াকে জোর করে পানি খাওয়ানো যায় না –
আসলে এসব কিছু হলো ফাঁকি দেয়ার ফন্দি-ফিকির। কথায় বলে you can’t make drink an unwilling horse। নিজেদের সীমাহীন সুবিধাবাদিতা ও কর্মবিমুখতাকে ঢাকার জন্য জামায়াতের উচ্চ শিক্ষিত লোকজনেরা সংস্কারের কথাবার্তা বলেন ও মৃদু দাবি তুলে থাকেন। আমি ওসবের মধ্যে নাই। I am always a theorist-activist.
২.০ ইবাদাতের বিষয়ে শুদ্ধবাদিতা –
জামায়াতের সংস্কারবাদীরা ইবাদাতের বিষয়ে শুদ্ধবাদিতাতে ভোগেন। বলতে পারেন, এত ছোট একটা বিষয়কে আমি এভাবে হাইলাইট করছি কেন? হ্যাঁ, বিষয় হিসাবে এটি আপাতদৃষ্টিতে একটা অনুল্লেখ্য ব্যাপার। কিন্তু একটু ভালো করে খতিয়ে দেখলে দেখবেন, ইবাদাতের বিষয়গুলোতে এই শুদ্ধতাবাদিতা তথা পিউরিটানিজমের সাথে অনেক বড় ব্যাপার জড়িত।
২.১ আক্বীদাগত দিক থেকে সমস্যাগ্রস্তদেরকে সহযোগিতা করার পদ্ধতি –
দেখুন, ইসলামপন্থীদের ঘোষিত লক্ষ্য হলো বাংলাদেশকে একটি ইসলামী কল্যাণ রাষ্ট্রে পরিণত করা। তো এ দেশে হাজার বছর হতে যে ইসলাম আছে তা ট্রাডিশনাল সুন্নী ধারার হানাফী মাজহাবের। এই ‘লোক-ইসলামে’র মধ্যে কোনো কোনো গ্রুপের মারাত্মক আক্বীদাগত সমস্যা আছে। এই সমস্যাকে কীভাবে দীর্ঘস্থায়ী মেয়াদে সংশোধন করা যায় সে চেষ্টা করার পরিবর্তে চরমপন্থী প্রতিক্রিয়াশীলদের মতো একদা সক্রিয়, এখন তুলনামূলকভাবে নিষ্ক্রিয় জামায়াত নেতা-কর্মীদের অন্যতম কমন বৈশিষ্ট্য হলো ‘বাতিল’দেরকে হেনস্থা করা ও হেয় প্রতিপন্ন করা। এমন কি এ ধরনের আক্রমণাত্মক দৃষ্টিভঙ্গিকে উনারা খুব এনজয় করেন। অনেকটা ঈমানী কর্তব্য ও করণীয় মনে করেন। দেশের আক্বীদাগত দিক থেকে সমস্যাগ্রস্ত মুসলমানদেরকে সহায়তা করার যে ইতিবাচক মানসিকতা তা তাদের নাই।
এ জন্য জায়গায় জায়গায়, মসজিদে মসজিদে নিরেট দ্বীনি আমেজে মজলিশ কায়েম করা এবং প্রত্যেক এলাকায় কোরআন ও হাদীসের অবিতর্কিত (classical) শরাহ-কিতাবের পঠন-পাঠনের ব্যবস্থা করা জরুরি। এসব বিষয়কে তারা কখনো ফিল করেন না।
২.২ ইতিহাস, ঐতিহ্য ও লোক–সংস্কৃতির প্রতি চরম অশ্রদ্ধা –
তাবলীগ জামায়াতসহ দেশের মাদ্রাসাকেন্দ্রিক যেসব সংগঠন ও প্রতিষ্ঠান রয়েছে সেসবের সমালোচনা করা, তাদের কাজের নানা রকমের সীমাবদ্ধতা ও খুঁত বের করা ও এসবকে ‘খেদমতে দ্বীন’ হিসাবে ট্যাগ লাগিয়ে খারিজ করে দেয়ার ব্যাপারে জামায়াতের সংগঠনবাদী ও সংস্কারবাদীরা মাশাআল্লাহ হাতে-হাত, কাঁধে-কাঁধ, ভাই-ভাই এক …! নিজেরা ছাড়া অন্য কারো সম্পর্কে তাদের অন্তরে তেমন কোনো শ্রদ্ধাবোধ আছে, এমন মনে হয় না। মনে হয়, ইসলামকে যেন জামায়াতে ইসলামী এ দেশে কাঁধে করে নিয়ে এসে সবাইকে ধন্য করেছেন। ইতিহাস, ঐতিহ্য ও লোক-সংস্কৃতির প্রতি কেমন অশ্রদ্ধা …!
২.৩ মাজহাবী বিতর্ককে পরিহার করাই সঠিক কর্মপন্থা –
আমাদের দেশের মানুষ মূলত হানাফী মাজহাবের অনুসারী। যারা ইসলামের জন্য দেশের মানুষকে ঐক্যবদ্ধ করার কথা, অংকের সরল নিয়মে তাদের তো মাজহাবী বিতর্ককে সর্বোতোভাবে পরিহার করে চলার কথা। তা না করে তারা বরং নানাভাবে প্রতিষ্ঠিত হানাফী মাজহাবের বিরোধিতা করেন। হানাফী মাজহাবই একমাত্র সহীহ – এমন দাবি যেমন ভুল, তেমনি হানাফী মাজহাব অনুসারে কেউ ইবাদাত ইত্যাদি করলে তাকে কার্যত ভুল সাব্যস্ত করতে হবে – এ ধরনের মন-মানসিকতায়ও অগ্রহণযোগ্য।
২.৪ রিলিজিয়াস সেক্টরে ভুল মেসেজ যাচ্ছে –
হানাফী মাজহাব সমর্থিত কোনো আমলের পক্ষে যদি ন্যূনতম দলীল থাকে তাহলে সে সব নিয়ে বাড়াবাড়ি না করাই তো সামাজিক-উদ্যোক্তা (social-entrepreneur) হিসাবে ইসলামী আন্দোলনের নেতাকর্মীদের কাছ হতে প্রত্যাশিত। তাই না? স্মরণ রাখতে হবে, এদেশে ইসলাম কায়েমের জন্য সবচেয়ে বড় ও সর্বাধিক কার্যকরী স্তম্ভ বা সাপোর্ট বেইজ হলো রিলিজিয়াস সেক্টর। জামায়াত কিংবা এ ধরনের কোনো ফোর্সকে মানুষ যখন তাদের দ্বীনি অনুভূতির রক্ষক ও বাস্তব রূপায়ণ হিসাবে দেখবে, পাবে, কেবলমাত্র তখনই জামায়াত কিংবা এ ধরনের কারো পক্ষে এ দেশে ইসলামের নামে কিছু একটা করা এবং টিকে থাকা সম্ভব হবে।
২.৫ রিলিজিয়াস সেক্টরই ইসলাম কায়েমের মূল শক্তি –
শুধুমাত্র এই একটি সেক্টরই ইসলামপন্থীদের একচ্ছত্র। রাজনীতি বলুন, সংস্কৃতি বলুন, সমাজসেবা বলুন, অর্থনৈতিক সামর্থ্য বলুন, আন্তর্জাতিক সম্পর্ক ও সামর্থ্য বলুন, কোনো দিকেই ইসলামপন্থীরা কখনো একচ্ছত্র তো দূরের কথা, সেরাও হতে পারবে না। বড়জোর উল্লেখযোগ্য বিকল্প হতে পারবে।
২.৬ ইত্তেহাদ মায়াল ইখতেলাফ –
অথচ, নানাভাবে হানাফী মাজহাবের বিরোধিতার মাধ্যমে দেশের বৃহত্তর ইসলামপ্রিয় জনগোষ্ঠীর কাছে একটা ভুল মেসেজ যাচ্ছে। আমি এসবের সাথে নাই। আমি সবাইকে নিয়েই চলার পক্ষপাতী। ইবাদাতের বিষয়ে আপাতদৃষ্টিতে নির্দোষ ও তুচ্ছ শুদ্ধবাদিতার পরিণামে ‘ইত্তেহাদ মায়াল ইখতেলাফ’ তথা মতবিরোধ সত্বেও ঐক্যের যে ফর্মুলা তা ক্ষতিগ্রস্ত হচ্ছে। মাওলানা মওদূদীকে বিশেষ করে ক্বওমী ধারার সাথে বিরোধ মিটিয়ে ফেলার কার্যকর উদ্যোগ না নেয়ার জন্য দোষারোপ করার ক্ষেত্রে জামায়াতের সংস্কারবাদীরা উচ্চকণ্ঠ। অথচ তারা নিজেরা তুচ্ছ ইবাদতি ইখতিলাফের মধ্যে নিজেদের জড়িয়ে এদেশের মূলধারার ইসলামপন্থীদের সাথে নিজেদের অনতিক্রম্য দূরত্ব সৃষ্টি করছেন …! কোনো বিষয় নিয়ে সিরিয়াসলি ইনভলভলড হয়ে কোনো ওয়ে আউট বের করার জন্য যে স্থিরতা ও কমিটমেন্ট লাগে, যে উদার ও নিরবচ্ছিন্ন চিন্তাভাবনার প্রয়োজন হয়, যে ধরনের সামগ্রিক দৃষ্টিভঙ্গি ও ইতিবাচক মানসিকতা লাগে তা জামায়াতের সংস্কারবাদীদের মধ্যে আমি আদৌ দেখতে পাই না।
(চলবে)
[নোটঃ লেখকের দেয়া মূল শিরোনামটি আংশিক সম্পাদিত হয়ে প্রকাশ করা হ্যেছে।মুল শিরোনাম ছিলঃ “কেন আমি জামায়াতের সংস্কারবাদী নই”]
আসসালামু আলাইকুম ওয়া রহমাতুল্লাহ…..
পয়েন্টভিত্তিক সুন্দর নোট, জাযাকাল্লাহ
২.৩ …. “বরং নানাভাবে প্রতিষ্ঠিত হানাফী মাজহাবের বিরোধিতা করেন।…”
এ বাক্যাংশটুকুর পরিসর সীমিত করলে ভাল হয় মনে করি!
আমার পর্যবেক্ষণে জামায়াতে এখনো হানাফী মাজহাবের অনুসারীদের বিপূল সংখ্যাগরিষ্টতা রয়েছে- যদিও আহলেহাদীস অনুসারীগণ অধিক ততপর বিধায় তাঁদের সংখ্যা বর্ধিষ্ণু! কিন্তু সেটার কারণ মনে হয় এ ছাড়া অন্য কিছু নয় যে, সাধারণ শিক্ষিত মানুষেরা তাঁদের দলিলভিত্তিক আলোচনায় প্রভাবিত হচ্ছেন এবং হানাফী ফিকাহর মাসআলাগুলোর দলিলভিত্তিক আলোচনা তেমনভাবে হচ্ছেনা! কিন্তু যাঁরা মাসআলাগত মোটামুটি জ্ঞান রাখেন তাঁরা তেমন প্রভাবিত নন! অবশ্য কোন কোন মাসআলায় অধিকতর বিশুদ্ধতার দিকে পরিবর্তনকে “মাযহাবী পরিবর্তন” গণ্য করা ঠিক হবেনা!!